পশ্চিমবঙ্গে সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলগুলির এমনিতেই অভাবের সংসার। অভাব ছাত্রছাত্রীর, স্কুলে সুষ্ঠু পরিকাঠামোর, শিক্ষকের। সব সয়েও যে স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থা চলছে তার কারণ শিক্ষকেরা: পড়ানো, পরীক্ষা নেওয়া, আরও নানা ধকল সামলে তাঁরা পড়ুয়াদের সার্বিক বিকাশের চেষ্টা করেন খেলার মাঠ, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি ঘিরে। এ রাজ্যে সরকারি স্কুলে লাইব্রেরির ছবিটি সুখের নয়, তবু শিক্ষা দফতরের দেওয়া টাকায় এত দিন শিক্ষকেরা অন্তত নিজেদের ও ছাত্রছাত্রীদের পছন্দমতো বই কিনতে পারতেন। তালিকা তৈরি করে, দূরদূরান্ত থেকে কলকাতায় বই দেখতে আসতেন, কিনে নিয়ে যেতেন। এই ব্যবস্থাই এ বার বন্ধ হতে চলল। রাজ্যের স্কুল পরিদর্শকদের পাঠানো নোটিসে শিক্ষা দফতর সম্প্রতি পাঁচশোরও বেশি বইয়ের তালিকা ও সেট বেঁধে দিয়েছে, সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলগুলিকে তার মধ্যে থেকেই বই বাছতে হবে। ২০২৬টি স্কুল বই বাবদ এক লক্ষ করে টাকা পাবে ঠিকই, কিন্তু বই কেনার সিদ্ধান্ত বা কাজটিও আর তাদের হাতে থাকল না।
শিক্ষকেরা ক্লাসে কী পড়াবেন, কোন বই থেকে, তা তো শিক্ষা দফতরের বেঁধে দেওয়া ছিলই। এ বার দেখা গেল, সেই তালিকায় রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর অনেকগুলি বই: দুয়ারে সরকার, দুয়ারে সরকার আমার আপনার, মানুষের পক্ষে উন্নয়নের লক্ষ্যে, জাগরণের বাংলা, কবিতাবিতান, কথাঞ্জলি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের পাশে মুখ্যমন্ত্রীর লেখা বই পশ্চিমবঙ্গের শিশুসমাজের পাঠ্য হয় কোন অধিকারে? মুখ্যমন্ত্রী কি এতই বড় মাপের লেখক বলে নিজেকে মনে করেন? ঠিক যেমন বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসক যুগে যুগে মনে করে এসেছেন? তাঁর কবিতাবিতান বা কথাঞ্জলি পাঠে পড়ুয়াদের সাহিত্যবোধ ঋদ্ধ হবে— সত্যিই কি মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রান্তের সেবকরা ছাড়া আর কেউ তা মনে করেন? মুখ্যমন্ত্রীর লেখালিখির অভ্যাস তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার, আর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্য ও সিলেবাসের বাইরের বই বাছাই সম্পূর্ণ ভিন্ন, অতি জরুরি বিষয়, তার গুরুত্বও সুদূরপ্রসারী। মুখ্যমন্ত্রী ছবি আঁকতে ভালবাসেন বলে কি এর পর তাঁর আঁকা ছবি স্কুলে আঁকার ক্লাসের ‘রেফারেন্স’ হবে? উপরন্তু স্কুল স্তরেই পড়ুয়ারা তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কাজকর্ম জানুক, তার অনুরক্ত হোক, এটাও কি ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি নয়?
আশঙ্কা হয়, শিক্ষা দফতর বা অন্য কোনও দফতরের পক্ষেই নেত্রী-ভজনা, বা তাঁর নেকনজরে থাকার কৌশল ভিন্ন গত্যন্তর নেই। স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছে দেওয়ার কাজটিতে আবার জড়ানো হয়েছে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডকে, তারাই বই-বাহকের কাজটি করবে। এ-ই কি তাদের কাজ হওয়ার কথা? বলা হচ্ছে, অনেক স্কুল এত দিন শিক্ষা দফতরের নিয়ম মেনে বই কিনত না, দফতরের দেওয়া টাকা খরচ করত না, তাই নাকি এই ব্যবস্থা। অথচ এই অনিয়ম হয়ে থাকলে শিক্ষা দফতর একটু কড়াকড়িতে সহজেই তা আটকাতে পারত। তার বদলে স্কুলের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল পূর্বনির্দিষ্ট বই-তালিকা। স্কুল কর্তৃপক্ষ তালিকা থেকে বই বেছে বরাত দিতে পারবেন বলা হচ্ছে বটে, কিন্তু মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর বইগুলি তাঁরা বাছছেন বা কিনছেন কি না, তাতে যে নজরদারি বা জবরদস্তি হবে না, কে বলতে পারে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)