যে বিপদ জানা, তার মোকাবিলা তবু করা যায়। অজানা বিপদের প্রতিকার দূরস্থান, প্রতিরোধ যে করতে হবে সেই ধারণাও সাধারণ মানুষ পাবেন কী করে? বিহারের বেশ কয়েকটি জেলায় মায়েদের নিয়ে করা এক স্বাস্থ্য-গবেষণায় মাতৃদুগ্ধে বিপজ্জনক মাত্রায় ইউরেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নানা পাথরের উপাদানে মিশে থাকা মৌলটি মাটির তলায় সঞ্চিত জলের সঙ্গে মিশেছে, পরে পানীয় জল দ্বারা বাহিত হয়ে এই মায়েদের শরীরে সঞ্চিত হয়েছে, এবং সঞ্চারিত হয়েছে মাতৃদুগ্ধেও— গবেষণার পর্যবেক্ষণ এমনই। ভোজপুর সমস্তিপুর বেগুসরাই কাটিহার নালন্দা-সহ কয়েকটি জেলার যত জন প্রসূতির মাতৃদুগ্ধের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তার ৭০ শতাংশেই ইউরেনিয়ামের মাত্রা বিপজ্জনক, কাটিহারে সবচেয়ে বেশি। নবজাতদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধের কোনও বিকল্প নেই, অথচ তারই সূত্রে নানা রোগ-অসুখের আশঙ্কা থাকছে: শিশুদের কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে, পরে হতে পারে ক্যানসারও।
যে ভাবে আর্সেনিক, সিসা বা পারদ মাটি থেকে জলবাহিত হয়ে মানবশরীরে ঢোকে, সেই পথেই যে ইউরেনিয়ামও ঢুকে পড়ছে, তা বোধগম্য। ভারতের যে রাজ্যগুলি খনিজসমৃদ্ধ, তাদের মাটি, ভূগর্ভে সঞ্চিত জল ও মাটির উপরে নাগরিকের ব্যবহারের পানীয় জল নিয়ে এ ধরনের গবেষণা করলেই তা ধরা পড়ার কথা— অনেক ক্ষেত্রেই তা ধরা পড়েছেও। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞরা যেমন এ নিয়ে নানা সময়ে সতর্ক করেছেন, আবার এও বলেছেন যে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রেচনক্রিয়ার সঙ্গে বিপজ্জনক মৌলগুলি অনেক সময় বেরিয়ে যায়। কিন্তু বিহারের ঘটনায় বিপদ অন্যতর: একে তো নবজাতদের রেচনতন্ত্রের গঠন পূর্ণাঙ্গ না হতেই তারা ইউরেনিয়াম-দূষণের শিকার হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, এ ক্ষেত্রে এই দূষণের উৎসটিও সরিয়ে দেওয়ার কোনও উপায় থাকছে না কারণ মাতৃদুগ্ধই শিশুদের প্রধান ও অপরিহার্য খাদ্য— শিশুদের বাড়বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে পুষ্টি, সব কিছুর মূলে তা। মায়ের দুধ খেলে শিশুশরীরে বিষাক্ত মৌল ঢুকবে, অথচ না খাওয়ালে চলবেও না— এই ভয়ঙ্কর পাকচক্রে বাঁধা পড়ছে শিশুরা।
এই নিঃশব্দ ও ভয়ঙ্কর আক্রমণ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় সরকারি পদক্ষেপ— অবিলম্বে, এই মুহূর্তে। আধুনিক জীবনযাত্রায় বিপজ্জনক ও বিষাক্ত মৌলের ঢুকে পড়া আজ নতুন কথা নয়, তার অনেকাংশই নাগরিকের নিজস্ব জীবনযাত্রা ও বিশেষত খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গেও সংযুক্ত। কিন্তু প্রসূতি ও সদ্যোজাত শিশুর ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি যেখানে জড়িয়ে, সেখানে আর কোনও কথাই চলে না— সরকার তথা রাষ্ট্রকে এই সঙ্কট সমাধানের দায়িত্ব নিতেই হবে। গবেষকদের পর্যবেক্ষণে সমাধানের সূত্রটি রয়েছে— যে কোনও বিষাক্ত মৌলের দূষণকে যেন সরকার জনস্বাস্থ্যের সঙ্কট হিসেবে গ্রাহ্য করে, সেটি প্রথম কাজ। পরের কাজগুলিও পুর ও স্বাস্থ্য-প্রশাসনেরই— কঠোর বায়ো-মনিটরিং, ব্যাপক ভাবে ভূর্গভস্থ জল ও নাগরিকের পানীয় জলের গুণাগুণ যাচাই, রাজ্য থেকে জাতীয় স্তরে ভূতত্ত্ব সংস্থাগুলিকে সঙ্গে নিয়ে বিপজ্জনক মৌল-দূষণ চিহ্নিত করা ও তা কমিয়ে আনার কাজে তাদের সহযোগ নিশ্চিত করা। সবার আগে দরকার প্রশাসনের টনক নড়া— বিপদকে বিপদ বলে মেনে না নিলে পরিত্রাণ সুদূরপরাহত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)