Advertisement
E-Paper

খড়কুটো

এই সার্বিক দুর্নীতিগ্রস্ততার অভিযোগ আজ এমন প্রকট, তার অন্যতম কারণ হল, রাজ্যের রাজনৈতিক শ্রেণি তাদের ক্ষমতাকে অন্যায্য খাজনা আদায়ের কাজে ব্যবহার করেছে।

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৫৩

পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা-দুর্নীতির প্রকৃত ছবিটি কী রকম, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় একটি বাক্যে তাকে মোক্ষম ধরেছেন— ‘মুড়িমুড়কির মতো দুর্নীতি’। উপচে পড়া, অন্তহীন দুর্নীতির অভিযোগ। প্রথম যখন নিয়োগ-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ্যে আসতে আরম্ভ করে, সম্ভবত কেউ অনুমানও করতে পারেননি তার ব্যাপ্তি এত বিপুল, তার গভীরতা এমন অতল। কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, বুঝে ওঠা যায় না, সে দুর্নীতির অভিযোগ এমনই অভাবনীয়। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, প্রমাণ মিললেই শাস্তি হবে। বিচারব্যবস্থার উপর আস্থাই আপাতত গণতন্ত্রের খড়কুটো। ফলে, রাজ্যবাসী বিশ্বাস করতে চাইবেন যে, সত্যিই সব দুর্নীতিগ্রস্তের শাস্তি হবে। আশা করা যায় যে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও কঠোর শাস্তি পেলে তা মানুষের মনে ভয় তৈরি করবে— দুর্নীতিতে জড়িত হলে শাস্তি পাওয়ার ভয়। আইনের প্রতি এই ভয় আইনের শাসনের প্রধান আয়ুধ, কারণ জনে জনে শাস্তি দেওয়া বিবিধার্থে ‘ব্যয়বহুল’ কাজ। সংঘটিত দুর্নীতির ফলে আর্থিক ক্ষতির ‘ব্যয়’ তো বটেই, প্রত্যেকের বিচারের জন্য দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া, শাস্তি দিতে রাষ্ট্রের বিবিধ আর্থিক ব্যয়— সব মিলিয়ে শাস্তি বস্তুটি সস্তা নয়। কিন্তু, শাস্তির ভয় যদি প্রকৃত এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অতি কার্যকর প্রতিরোধক হতে পারে। আশা করা চলে যে, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাগুলিকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করবে।

কিন্তু, যে সমাজ শুধুই শাস্তির ভয়ে দুর্নীতি থেকে দূরে থাকে, তাকে আদর্শ সমাজ বলা মুশকিল। সভ্যতার প্রকৃত পাঠ বলবে যে, প্রশ্নটি পরিণতির নয়, প্রশ্ন মৌলিক মূল্যবোধের— দুর্নীতি খারাপ, অনৈতিক, সেই কারণেই তা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। ধরা পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও সভ্য, নৈতিক সমাজে দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু, ভারতীয় রাজনীতি সাক্ষ্য দেবে যে, এ দেশের জলহাওয়াতে এমন কিছু আছে যাতে তেমন সমাজের কথা আর কল্পনাও করা যায় না। সব কালে, সব দেশেই দুর্নীতি এমন সর্বজনগ্রাহ্য নয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা প্রতি বছর যে গ্লোবাল করাপশন ইনডেক্স বা বৈশ্বিক দুর্নীতি সূচক প্রকাশ করে, সেই তালিকা দেখলে আদ্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত দেশেরও যেমন সন্ধান মিলবে, তেমনই খোঁজ পাওয়া যাবে অতি সৎ দেশেরও। এবং, দেশের দুর্নীতিহীনতার সঙ্গে তার অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যেরও একটি ইতিবাচক সম্পর্কের হদিস পাওয়া যাবে। সামাজিক বিশ্বাস বস্তুটি দেশের অর্থনীতির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই, কোনও একটি নির্দিষ্ট জনপদের সার্বিক দুর্নীতিগ্রস্ততাকে অপরিহার্য ভবিতব্য ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। এই পাপ স্বোপার্জিত।

এই সার্বিক দুর্নীতিগ্রস্ততার অভিযোগ আজ এমন প্রকট, তার অন্যতম কারণ হল, রাজ্যের রাজনৈতিক শ্রেণি তাদের ক্ষমতাকে অন্যায্য খাজনা আদায়ের কাজে ব্যবহার করেছে। শুধু তো স্কুল-নিয়োগেই দুর্নীতি নয়, নির্মাণ সামগ্রীর সিন্ডিকেট থেকে কয়লা খাদান, ত্রাণ বণ্টন থেকে কর্মসংস্থান যোজনা, প্রতিটি ক্ষেত্রকেই কার্যত খুলে দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনি মুনাফা অর্জনের জন্য। প্রত্যেকেই বুঝে নিয়েছেন যে, এ ভাবে রোজগার করাই দস্তুর— এই রাজ্যে রাজনীতিই কর্মসংস্থানের বৃহত্তম ক্ষেত্র। সামাজিক স্তরে এই অবিশ্বাসের চাষ পশ্চিমবঙ্গকে আরও অতলে নিয়ে চলেছে। এই প্রবণতার গোড়াপত্তন বর্তমান জমানায় হয়েছে, বললে অনৃতভাষণ হবে— আগের জমানাতেও লোকাল কমিটির হাতে কাঞ্চনমূল্য ধরে দেওয়ার দস্তুর ছিল। বর্তমান জমানায় যা হয়েছে, এক অর্থে তা দুর্নীতির গণতন্ত্রীকরণ— এখন রাজ্যে কার্যত প্রত্যেকেই দুর্নীতির অধিকারী। বিচারের খড়্গ তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি?

Justice Abhijit Gangopadhyay Calcutta High Court
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy