বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ‘বুলিয়িং’ বা পরপীড়ন স্বাস্থ্যহানির কারণ ও তা প্রতিহত করা সম্ভব। স্কুলপড়ুয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনসমাজে এই কুঅভ্যাস কী আঘাত হানে তাও বহু চর্চিত। ‘র্যাগিং’ ও ‘বুলিয়িং’-এ প্রভেদ থাকলেও দুই-ই একই তারে বাঁধা, ‘স্যাডিজ়ম’-উদ্ভূত। সাধারণত, র্যাগিং-এর ক্ষেত্রে দল বেঁধে অগ্রসর হয়ে হুমকি, অপমান, নিপীড়ন চলে, বুলিয়িং-এ এক জন বার বার অপমান, উৎপীড়নের শিকার হয়। মনোচিকিৎসকরা বহু দিন সতর্ক করেছেন, অন্যকে দুঃখ দিয়ে, লজ্জাবোধ করতে বা কষ্ট পেতে দেখে উপভোগের আচরণ পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকেই লক্ষ করা যায়। সম্প্রতি কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকরা এই মতটির সপক্ষে কিছু প্রমাণ পেয়েছেন। তাঁদের উদ্বিগ্ন পর্যবেক্ষণ, আগে দশ-এগারো বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে হেনস্থার প্রবৃত্তি নিয়ে তাঁদের সজাগ থাকতে হত। ইদানীং পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের মধ্যেও সমবয়সিকে দমনের প্রবণতা বেড়েছে। সহপাঠীর অচেনা ধরনের জীবনাভ্যাস, শৌখিন পণ্য বা বিশেষ স্মার্টফোন জাহির— এ সবই হেনস্থার মূলে।
শৈশবের এই পর্যায়টি সমাজচেতনা ও ব্যক্তিত্বের ক্রমবিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনই শিশু বৃহত্তর অঙ্গনে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করে, বন্ধুত্ব শেখে। এ সময় আক্রোশমূলক ব্যবহারে তার মন ও মেধার বিকাশ বিধ্বস্ত হয়, স্কুল নিয়ে সুখস্মৃতির সম্ভাবনাটাই খোয়া যায়, মানসিক বিপর্যয় তার ভবিষ্যতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। শুধু নিপীড়িত শিশু নয়, বিশেষ নজরের আওতায় আনতে হবে উৎপীড়ক পড়ুয়া ও তার পরিবারকেও। হয়তো সেখানে বার্তালাপ, আচরণে বিদ্বেষ অসহিষ্ণুতার বাতাস ভারী। শিশু সেই স্বভাব নকল করে শ্রেণিকক্ষের বৃত্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বলের প্রতি প্রয়োগ করছে। আর এক বড় কারণ স্মার্টফোনে বিনোদনের মোড়কে বিকৃত তথ্যের প্লাবন। সেখান থেকেও দুর্ব্যবহার, হিংস্র প্রবৃত্তি, সহজে নজর কাড়ার প্রবণতা শেখা সম্ভব।
মৌখিক, শারীরিক, বন্ধুমহলে ব্রাত্য করে মানসিক উৎপীড়ন, সাইবার-নিপীড়ন, যৌন শোষণ— এই জটিল ডিজিটাল যুগে ‘বুলিয়িং’-এর রূপ ও প্রকৃতি প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। শিশু ভোলানাথের জগতে এই নিষ্ঠুর মানসিকতার অনুপ্রবেশ তারই একটি উদাহরণ। বিপজ্জনক এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চাই অনবরত নজরদারি, সহায়তার আশ্বাস, সংশোধনের চেষ্টা। প্রাক্-কৈশোর থেকেই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, প্রাথমিক বিভাগে আচরণের আলাদা পাঠ্যক্রম তৈরি দরকার। সেখানে সামাজিক চেতনা, সহানুভূতি ইত্যাদি গড়ে তোলা যাবে যা আন্তর্জাল-নিঃসৃত আমিত্বের বিষকে প্রশমিত করবে। এক সঙ্গে ভ্রমণ, বৃদ্ধাশ্রমে সময় কাটানো ইত্যাদি এ কাজে ফলপ্রসূ হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা জানাতে ছোটরাই তৎপর থাকবে। যে ভাবে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অ্যান্টি-র্যাগিং সেলের মাধ্যমে অন্যায়কে রোখার চেষ্টা চলছে, সময় এসেছে স্কুল পর্যায়েও নিরপেক্ষ কমিটি গঠনের। ডিজিটাল ভাষ্যে সাবলীল কাউন্সেলর, সহমর্মী শিক্ষক, অভিভাবকদের প্রতিনিধি নিয়ে এমন কমিটি সক্রিয় থাকলে ঘটনাগুলিকে লঘু করার, নজর-ক্যামেরাকে কেবল সাজ-সামগ্রী করে রাখার অভ্যাস মিটবে। শিক্ষায়তনগুলি যাতে বিধিগুলিতে যত্নবান হয়, নিশ্চিত করবে প্রশাসনই। অপ্রাপ্তবয়স্ককে সুরক্ষা দান— অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রিক দায়িত্ব।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)