শেষ পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করার পথনির্দেশিকা দিল না ব্রাজ়িলের বেলেম-এ অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের ৩০তম জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বিপন্ন দেশগুলির সম্মিলিত চাপও শেষ পর্যন্ত কার্যকর হল না। এই ঘটনাক্রমকে অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত বলার কোনও কারণ নেই। বস্তুত, অন্য রকম পরিণতি হলেই তাতে অবাক হওয়ার কারণ থাকত। কেন, তা বোঝার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট— এই সম্মেলনেই জানা গেল যে, ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে সীমা ধার্য করেছিল, তা লঙ্ঘিত হতে চলেছে। অর্থাৎ, শিয়রে বিপদ জেনেও গোটা দুনিয়া তাকে অবজ্ঞা করেছে; প্রতিটি দেশই মন দিয়েছে নিজস্ব স্বার্থে। জীবাশ্ম জ্বালানি এই ‘নিজস্ব স্বার্থ’-র একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। আমেরিকা থেকে গোটা আরব দুনিয়া হয়ে রাশিয়া, এবং সম্মেলনের আয়োজক ব্রাজ়িল-সহ লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশে খনিজ পেট্রলিয়ামের ভান্ডার বিপুল। এই দেশগুলির মধ্যে কয়েকটির অর্থব্যবস্থা এই খনিজ পেট্রলিয়ামের উপরে বহুলমাত্রায় নির্ভরশীল। আবার, ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ তার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির উপরে নির্ভরশীল। কাজেই, জীবাশ্ম জ্বালানি ‘ফেজ় আউট’ করতে চাইলে উৎপাদক এবং ক্রেতা, উভয় পক্ষই তাতে আপত্তি করে। বেলেমেও ফেজ় আউট-এর পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত ঠেকে গেল সেই আপত্তিতেই। অন্তত চাহিদার দিক থেকে এই সমস্যার সমাধান করতে হলে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বিকল্প শক্তির দিকে। পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে হাইড্রোজেন জ্বালানি, সব ক্ষেত্রেই জোর দিতে হবে। সেই বিকল্পের খরচ যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে কম হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এবং, গোটা কাজটিই করতে হবে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রাক্-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দু’ডিগ্রি বেশি স্তরে স্থায়ী ভাবে পৌঁছে যাওয়ার আগেই। প্রশ্ন হল, পরিবেশ কূটনীতি সে পথে হাঁটার জন্য তৈরি কি?
সম্মেলনের অন্তিম বয়ানে বলা হয়েছে, পরিবেশ রক্ষার্থে একতরফা ভাবে গৃহীত বাণিজ্য নীতি যাতে বিশ্ব বাণিজ্যে কোনও অযৌক্তিক বাধা সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের জয়। ইউরোপের কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজ়ম (সি-ব্যাম)-এর মতো নীতি ভারতের মতো দেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে তৈরি করা পণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক আরোপ করে। তাতে সে পণ্য ইউরোপের বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হারায়। এই ‘বৈষম্যমূলক নীতি’র ক্ষেত্রে ভারত কখনও তার আপত্তি গোপন করেনি। ঘটনা হল, এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানটির যৌক্তিকতা স্বীকার না করে উপায় নেই। প্যারিস চুক্তি অনুসারে বায়ুমণ্ডলে যতখানি কার্বন থাকতে পারে, তার ৮০ শতাংশ ইতিমধ্যেই উপস্থিত, ঐতিহাসিক কারণে। এবং, সেই কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে আজকের উন্নয়নশীল বিশ্বের কার্যত কোনও দায় নেই, তা সম্পূর্ণ ভাবেই শিল্পবিপ্লবের সুফল ভোগ করা উন্নত বিশ্বের অবদান। যে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ কার্বন পরিসর রয়েছে, তাতেও উন্নত দুনিয়ার দখলই বেশি। ফলে, ভারতের মতো দেশ যদি কার্বন নিঃসরণের বর্তমান সঙ্কীর্ণ মাত্রা মেনে চলতে বাধ্য হয়, অথবা তা অমান্য করে শাস্তিমূলক শুল্কের সম্মুখীন হয়, তবে তাকে বৈষম্য বলে স্বীকার করতেই হবে। এই প্রশ্ন নিয়ে ভবিষ্যতেও দরাদরি চলবে। উল্টো দিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিশ্ব উষ্ণায়ন-অস্বীকারকারী বিশ্বনেতাদের কী ভাবে পরিবেশবান্ধব বৈশ্বিক উৎপাদন ও বাণিজ্য নীতি মানতে বাধ্য করা যায়, সে পথেরও সন্ধান করতে হবে। পাশাপাশি, এ সম্মেলনে জোর দেওয়া হয়েছে অ্যাডাপ্টেশন বা বিশ্ব উষ্ণায়নের নেতিবাচক পরিণতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কৌশলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক তহবিল বৃদ্ধি করার উপরে। এত দিনে এ কথা স্পষ্ট যে, উষ্ণায়ন-বিপন্ন দেশগুলিকে বাঁচাতে হলে অ্যাডাপ্টেশনই পথ। তার জন্য তহবিল নির্মাণের কাজে জোর দেওয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)