E-Paper

বিষচক্র

শহরের বাসিন্দাদের অবশ্য এত তথ্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না— কলকাতার বাতাসে শ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায় দূষণের প্রাবল্য।

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪১

Sourced by the ABP

ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ার ফলে বায়ুদূষণের পরিমাণ যেটুকু কমছে, মোট ব্যক্তিগত গাড়ির অনুপাত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বর্ধিত দূষণের কারণে সেই সুবিধাটুকু মাঠে মারা যাচ্ছে। সম্প্রতি দিল্লির বায়ুদূষণ সম্বন্ধে কথাটি জানাল পরিবেশ বিষয়ক এক গবেষণা সংস্থা। কথাটি শুধু দিল্লির জন্যই প্রযোজ্য নয়— ভারতের যে কোনও বড় শহরের ক্ষেত্রেই ছবিটি এই রকম। কলকাতায় তো বটেই। দিল্লির সঙ্গে তুলনা করলেই কলকাতার অবস্থাটি আঁচ করা যাবে— ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দিল্লিতে মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য ৩,১৯৮ কিলোমিটার, এবং রাস্তায় মোট গাড়ির সংখ্যা এক কোটি বত্রিশ লক্ষ, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় গড়ে গাড়ির সংখ্যা ৪০০-র কম; কলকাতায় রাস্তার দৈর্ঘ্য ১৮৫০ কিলোমিটার, গাড়ির সংখ্যা ৪৫ লক্ষ, অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় গড়ে গাড়ির সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। ভারতীয় শহরগুলির মধ্যে কলকাতাতেই এই গড় সর্বোচ্চ। ফলে, রাস্তায় গাড়ি নড়ে শম্বুকগতিতে, কিন্তু ইঞ্জিন বন্ধ করার উপায় না থাকায় দূষণ বাড়তে থাকে প্রবল হারে। শহরের বাসিন্দাদের অবশ্য এত তথ্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না— কলকাতার বাতাসে শ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায় দূষণের প্রাবল্য। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় শহরগুলিতে মোট যানবাহনের সাড়ে ছয় শতাংশ বিদ্যুৎ-চালিত। তেমন গাড়ির সংখ্যাবৃদ্ধির হার তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু শহরের সিংহভাগ গাড়ি বিদ্যুৎ-চালিত হয়ে উঠতে এখনও দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষা। ফলে, জীবাশ্মজ্বালানি-নির্ভর গাড়ির দূষণ থেকে বাঁচার অন্য পথও খোঁজা প্রয়োজন।

সেই পথের মন্ত্র হল ব্যক্তিগত পরিবহণ থেকে গণপরিবহণের দিকে সরে আসা। গোটা দেশ জুড়ে ঘটে চলেছে তার উল্টো ঘটনা— ক্রমেই গাড়ি এবং মোটরসাইকেলের মতো ব্যক্তিগত পরিবহণের উপরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তার বৃহত্তম কারণ হল গণপরিবহণ আদৌ নির্ভরযোগ্য এবং সুবিধাজনক নয়। কলকাতার মেট্রো রেলের নেটওয়ার্ক অতি বিলম্বে হলেও ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু, মেট্রো স্টেশনগুলিতে পৌঁছনোর জন্য নির্ভর করতে হয় অটোরিকশার উপরে, যার গতিবিধি যে কোনও মানুষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! শহরের বাসগুলি ক্রমেই হতশ্রী হয়েছে— জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশনের অধীনে যে বাসগুলি রাস্তায় নেমেছিল, সেগুলিরও বয়স হয়েছে, অবস্থাও খারাপ হয়েছে। প্রয়োজনের অনুপাতে রাস্তায় বাসের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ফলে, যাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি বা নিদেনপক্ষে মোটরবাইক ব্যবহারের সামর্থ্য আছে, তাঁরা গণপরিবহণ ত্যাগ করছেন। গণপরিবহণের উপরে যাঁরা নির্ভর করছেন, তাঁদের সিংহভাগ আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মানুষ; ফলে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের কণ্ঠস্বর অশ্রুতই থেকে যাচ্ছে। আরও বেশি অবহেলিত হচ্ছে গণপরিবহণ।

এই বিষচক্র থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য দ্বিমুখী নীতি প্রয়োজন। প্রথমত, গণপরিবহণকে প্রকৃতার্থে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি, মেট্রো রেলের সঙ্গে সংযোগকারী পরিবহণের ব্যবস্থা ইত্যাদি করতে হবে। বাসগুলির সর্বাঙ্গ থেকে মুছতে হবে অবহেলার ছাপ। প্রয়োজনের তুলনায় অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ কিন্তু অধিকতর আরামদায়ক বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। বাস চালাতে হবে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এবং, গণপরিবহণকে সম্পূর্ণ ভাবে বিদ্যুৎ-চালিত করতে হবে। অন্য দিকে, ব্যক্তিগত পরিবহণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৈরি করতে হবে কঠোর নেতিবাচক প্রণোদনা। সেন্ট্রাল বিজ়নেস ডিস্ট্রিক্ট অর্থাৎ শহরের প্রাণকেন্দ্রে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আসতে হলে মোটা টাকা কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে; পার্কিং ফি বাড়াতে হবে বিপুল পরিমাণে। এবং, ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার সময় মোটা অঙ্কের পরিবেশ সেস আদায় করতে হবে। কিন্তু, পরিবেশের কথা ভেবে গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলির ব্যবসার উপরে এমন নেতিবাচক নীতি নির্ধারণের সাহস সরকারের হবে কি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kolkata Delhi

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy