E-Paper

অভাবিত

দু’টি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, ইজ়রায়েলের জন্য বর্তমান আমেরিকা কত দূর যেতে পারে, তার সম্পূর্ণ নতুন মাইলফলক তৈরি হল।

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫ ০৮:৫১

পশ্চিম এশিয়ার একটি সুখ্যাত সংবাদমাধ্যম সংবাদ-শিরোনাম করেছে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দৌলতে বিশ্বদুনিয়া এখন ‘যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ’। প্রশংসাযোগ্য বটে; অনেক বক্তব্য এক সঙ্গে পেশ করাই যে-হেতু সার্থক শিরোনামের লক্ষ্য। ইরানের পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে আমেরিকা যে বোমাবর্ষণ করেছে, তার ভয়ঙ্করতা এখনও বহিঃপৃথিবীর কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। কতখানি ক্ষত ও ক্ষতি হল ইরানের, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেশ যে দাবিই করুক না কেন, বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা কঠিন। তবে সন্দেহ নেই, যে ভাবে অভাবিত ও অপ্ররোচিত বোমা বর্ষণ হল ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের উপর, তা ‘সফল’ না হলে কিন্তু বিপদ আগের থেকে অনেক বাড়তে পারে। প্রমাণিত হল যে, বাইরের দেশ এ ভাবেই ভয়ঙ্করতম হানা দিতে পারে, ফলে তার জন্য ‘অস্ত্র’ মজুত রাখা ভাল। ইরান আগাগোড়াই বলে আসছে যে তারা পরমাণু শক্তি নির্মাণ করছে, পরমাণু অস্ত্র নয়— যে দাবি ইজ়রায়েল বিশ্বাস করে না এবং ইরান তাদের আক্রমণ করতে পারে এই আতঙ্কে ভুগেই তারা যুদ্ধ শুরু করেছে। আমেরিকার শাসক মহলের মতও ইজ়রায়েলের মতের সঙ্গে মেলে, বোঝাই যাচ্ছে। তবে কিনা, এও ঠিক যে আমেরিকার সামরিক ও প্রশাসনিক মহল এ বিষয়ে একমত নয়— তাদের একাংশের বিবেচনায় সাম্প্রতিক কালে ইরান পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে অগ্রসর হয়েছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। এত কাল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেকনজরে থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূত তুলসী গাবার্ড এই মতে বিশ্বাসী বলেই এখন ট্রাম্পের বিদ্বেষভাজন। তবে কিনা, ইরান এত দিন পরমাণু অস্ত্রে মন দিয়ে থাকুক না থাকুক, এই সংঘর্ষের ফলে তাদের পরমাণু সক্ষমতা বা ‘নিউক্লিয়ার কেপেবিলিটি’ বিচূর্ণ না হয়ে গিয়ে থাকলে তারা নিশ্চিত ভাবে আবার উঠে দাঁড়াবে এবং ভয়ঙ্করতর ‘কেপেবিলিটি’-র দিকে ধাবিত হবে। সেই অর্থেই বিশ্ব এখন আরও অনেক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত— সে কথা বলাই যায়।

দু’টি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, ইজ়রায়েলের জন্য বর্তমান আমেরিকা কত দূর যেতে পারে, তার সম্পূর্ণ নতুন মাইলফলক তৈরি হল। ইতিমধ্যেই গাজ়ায় ইজ়রায়েলের মর্মান্তিক ধ্বংসকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার মাটিতে প্রতিবাদীদের লাগাতার নিষ্পেষণ চলেছে। এ বার তার সঙ্গে যোগ হল— ইজ়রায়েলের পক্ষ নিয়ে আমেরিকার প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অবতরণ। আমেরিকার রাজনীতিকরাই অনেকে বিস্মিত: এ যুদ্ধ তো ‘তাঁদের’ নয়, তা হলে কেন এই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ! বস্তুত, ইরানের সঙ্গে আমেরিকার শত্রুতা অনেক পুরনো, ১৯৭৯ সালের ‘ইরানি বিপ্লব’-এর পর থেকেই তা চলছে। এই শতকের গোড়ায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ (জুনিয়র) ঘোষণা করেছিলেন এক ‘অশুভ অক্ষ’-এর কথা— যার মধ্যে ইরানের নামটি জ্বলজ্বল করত। কিন্তু ইতিপূর্বে বুশ বা কোনও আমেরিকান প্রেসিডেন্টই ইরানের সঙ্গে সম্মুখসমরে প্রবৃত্ত হননি, বরং সন্তর্পণে সে সম্ভাবনা এড়িয়ে গিয়েছেন। ট্রাম্প বুঝিয়ে দিলেন, তিনি কেবল দেশাভ্যন্তরে নন, বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও দুমদাম বেমক্কা বল পিটিয়ে দিতে পারেন। বলটি কোথায় পড়ল, তাতে ভয়ঙ্করতম বিপদতোরঙ্গের দ্বার খুলে গেল কি না, এ সবই তাঁর কাছে তুচ্ছ। যুদ্ধ, এমনকি পরমাণুকেন্দ্রের উপর বোমাবর্ষণের মতো যুদ্ধের আগেও তিনি তাঁর দেশের অন্য জনপ্রতিনিধিদের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলেন না— গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বর্তমানের আমেরিকায় এতটাই নগণ্য। দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পরমাণু-প্রশ্নটি বিশ্বকূটনীতিতে একেবারে ভিন্ন মাত্রার বিপদ সূচিত করে। ট্রাম্পের আমেরিকা বুঝিয়ে দিল, তারা নিজের (এবং ইজ়রায়েলের) স্বার্থে বাকি পৃথিবীকে ভয়ঙ্করতম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে দ্বিধা করে না। প্রত্যাঘাতে ইরান যদি হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করে, তবে বিশ্বদুনিয়ায় অর্থনৈতিক সঙ্কটও পৌঁছবে ভিন্ন মাত্রায়। অন্য শক্তিধর দেশগুলি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চিন), এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ— বিপদ ঠেকাতে এখনই প্রয়াসী হোক। নতুবা এই নতুন ‘একমেরু বিশ্ব’ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Iran israel

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy