E-Paper

শুল্ক-যুদ্ধ

যে স্লোগানগুলি তাঁর প্রত্যাবর্তনের পিছনে গুরুতর ভূমিকা পালন করেছে, সেগুলির সত্য রক্ষা করতে গেলে চড়া আমদানি শুল্কের অস্ত্র ব্যবহার ব্যতীত ট্রাম্পের হাতে উপায়ও নেই।

শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৫

জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে পুনরায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব বাণিজ্যের মহাসমুদ্রে কোন সুনামি ঘটাতে চলেছেন, তার ইঙ্গিত মিলছে। তাঁর পেয়ারের অস্ত্র হল ট্যারিফ বা আমদানি শুল্ক। নির্বাচনের আগেই তিনি বলে রেখেছিলেন, তাঁর সবচেয়ে পছন্দসই শব্দটি হল ‘ট্যারিফ’। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ গোত্রের যে স্লোগানগুলি তাঁর প্রত্যাবর্তনের পিছনে গুরুতর ভূমিকা পালন করেছে, সেগুলির সত্য রক্ষা করতে গেলে চড়া আমদানি শুল্কের অস্ত্র ব্যবহার ব্যতীত ট্রাম্পের হাতে উপায়ও নেই। তাঁর সাম্প্রতিকতম হুমকিটি হল, ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলি যদি পারস্পরিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের বদলে নিজস্ব আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবহার করে, তবে আমেরিকায় সে দেশগুলির পণ্যের আমদানির উপরে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। হুমকিটি যে ফাঁকা নয়, সে আশঙ্কা করার কারণ আছে। প্রথম যে প্রশ্নটি মনে জাগে, তা হল, ট্রাম্প যদি শুল্ক-যুদ্ধ শুরু করতেও চান, তাঁকে ঠেকানোর কি কোনও পথ নেই? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন (ডব্লিউটিও) বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কোথায়? উত্তর হল, সংস্থাটি বর্তমানে নখদন্তহীন। এবং, তা আমেরিকার কারণেই। সংস্থার বিবাদ মীমাংসাকারী শাখা ডিসপিউট সেটেলমেন্ট বোর্ড-এ এখন সদস্যসংখ্যা কমতে কমতে এক-এ এসে ঠেকেছে। ভূতপূর্ব সদস্যদের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁদের পুনঃমনোনীত করতে অস্বীকার করেছিল ট্রাম্পের শাসনাধীন আমেরিকা। জো বাইডেনও তাঁর পূর্বসূরির পথেই হেঁটেছেন। ফলে, আমেরিকার বিরুদ্ধে অনৈতিক শুল্ক-যুদ্ধের অভিযোগ করা যেতেই পারে, তার মীমাংসা হবে না। আমেরিকাকেও সংযত করা যাবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অচলাবস্থা সম্বন্ধে বিলক্ষণ অবহিত। তিনি যে সমানেই শুল্ক-যুদ্ধের হুমকি দিয়ে চলেছেন, তার পিছনে এটি একটি বড় কারণ— তিনি জানেন, আপাতত তাঁকে নিরস্ত করা অসম্ভব।

ট্রাম্প যদি সত্যিই আমদানির উপরে চড়া শুল্ক আরোপ করতে থাকেন, তা হলে অন্য দেশগুলির উপরে তার কী প্রভাব পড়বে? ট্রাম্প ইতিমধ্যেই কানাডা, চিন ও মেক্সিকোকে বিশেষ হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তার মধ্যে চিন পূর্ববর্তী ট্রাম্প জমানার বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা স্মরণে রেখে ইতিমধ্যেই নিজেদের রফতানির বাজার পাল্টেছে। সে দেশের মোট রফতানির ১৪ শতাংশ এখনও আমেরিকার বাজারে যায় বটে, কিন্তু অনুপাতটি ক্রমহ্রাসমান। এবং, চিন যে ভাবে নিজেদের জন্য নতুন বাজার খুঁজে নিয়েছে এবং বাড়িয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে, আমেরিকার তরফে এমন শুল্ক-যুদ্ধের আশঙ্কা তাদের ছিলই, এবং তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছে। উল্টো দিকে, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যসম্পর্ক বাড়ছে। গত অর্থবর্ষে ভারতের মোট রফতানির ১৮ শতাংশ আমেরিকায় গিয়েছিল; বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে অনুপাতটি বেড়ে ১৯ শতাংশ হয়েছে। তার মধ্যে এমন কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যেগুলিতে ভারতের রফতানি মূলত আমেরিকান বাজারের উপরেই নির্ভরশীল। যেমন, ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্রের মোট রফতানির ৩৯ শতাংশ যায় আমেরিকায়; টেলিকম যন্ত্রাংশ রফতানির ৩৫ শতাংশ; বস্ত্রপণ্যের ৩৬ শতাংশ। মূল্যবান পাথর রফতানিরও ৩৫ শতাংশ হয় আমেরিকার বাজারেই। অন্য দিকে, ভারতের পরিষেবা রফতানিরও বৃহত্তম বাজার আমেরিকা। সুতরাং, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি সত্যিই ভারতের উপরেও চড়া শুল্ক আরোপ করেন, তা হলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপরে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে চলেছে বটে। তবে, বাণিজ্য কখনও একমুখী প্রক্রিয়া নয়। এক পক্ষ শুল্ক চড়ালে অপর পক্ষও অবধারিত ভাবে সেই পথেই হাঁটে। অতএব, শুল্ক-যুদ্ধ শুরু করলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে আমেরিকার শিল্পক্ষেত্রেও। এমনিতেই সে দেশে শিল্প-পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তার উপরে শুল্ক-যুদ্ধের আঁচ পড়লে মানুষ বিলক্ষণ চটবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত কি না, সে প্রশ্নটিও থাকছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tarriff World India Politics Diplomacy Donald Trump

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy