Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Desmond Tutu

ভূতপূর্ব

টুটু অধ্যাত্মবাদী নেতা, এবং তাহাই এই মানুষটির রাজনীতির ন্যায়পরায়ণতার প্রাণভ্রমরা, এই যুগে যাহা কেবল কষ্টকল্পনা নহে, অসেতুসম্ভব।

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৫৭
Share: Save:

দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু-র প্রয়াণে আক্ষরিক অর্থেই যুগাবসান হইল। সেই যুগ, যখন জননেতারা জনসমাজের সহিত রাজনীতির পাটিগণিতে সংযোগসাধন করিতেন না। তাহা ছিল মনুষ্যজাতির সার্বিক হিতসাধনে এক নৈতিক অনুশীলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হইতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই কৃষ্ণাঙ্গ পাদরি। ইহা সত্য যে, অ্যাংলিকান চার্চের শীর্ষস্থানীয় হইবার কারণে তাঁহাকে নেলসন ম্যান্ডেলা-সহ রাজনৈতিক সংগ্রামীদের ন্যায় কারাবাস বা দ্বীপান্তর বরণ করিতে হয় নাই। কিন্তু, জোহানেসবার্গের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিশপের পদাধিকারবলে তিনি যে ভাবে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহাও ব্যতিক্রমী। ইতিহাস সাক্ষী, ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রীয় বর্ণবৈষম্য নীতি অ্যাপারথেড-এর অবসান ঘটিলেও তাঁহার সংগ্রাম থামে নাই। বিবেকদর্পণের ন্যায় তিনি সদাসক্রিয়— গত তিন দশকেও প্রকৃত বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলিয়া গিয়াছেন। আপনার প্রভাবকে কী ভাবে জনকল্যাণের কাজে ব্যবহার করা যায়— ইহাই টুটুর অগ্রগণ্য শিক্ষা।

বর্তমান সময়ে এই শিক্ষার এক ভিন্ন অভিমুখও জরুরি। টুটু অধ্যাত্মবাদী নেতা, এবং তাহাই এই মানুষটির রাজনীতির ন্যায়পরায়ণতার প্রাণভ্রমরা, এই যুগে যাহা কেবল কষ্টকল্পনা নহে, অসেতুসম্ভব। এই ন্যায়ের জোরই পরাক্রমশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে অসম সংগ্রামে তাঁহাকে শক্তি জুগাইয়াছে, এবং তাহাতে জয়ী হইবার পর পরাজিতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের জন্ম হইতে দেয় নাই। বস্তুত, ধর্মের ভাষা কী ভাবে রাজনীতিতে গঠনমূলক ভূমিকা লইতে পারে, তাহা মহাত্মা গাঁধীর ন্যায়— অথবা, দলাই লামার ন্যায়— দেখাইয়াছেন টুটু। অধুনা ধর্মভিত্তিক যে রাজনীতির বান ডাকিয়াছে, তাহার মূল কথা বিভেদ, তাহার ফলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বহুত্ববাদের মর্যাদা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। তাহাতে সকলকে সম্মান করিবার কথা নাই, আছে বাদ দিবার বাগাড়ম্বর। টুটুর রাজনীতি তাই এই সময়ে শুধু প্রয়োজনীয় শিক্ষা নহে, সম্পূর্ণ বিপরীত এক বিশ্ববীক্ষা। রাষ্ট্রীয় শোকবার্তায় টুটুর ১৯৮৪ সালের নোবেলপ্রাপ্তির উল্লেখ করিয়া নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলিয়াছেন: “শান্তি পুরস্কার কখনও এতাদৃশ যথাযথ হয় নাই।”

টুটুর স্বদেশাভিমুখে তাকাইলেও এই কথাটি স্পষ্ট হয়। অ্যাপারথেড-পরবর্তী যুগে ন্যায়বিচার দিবার প্রশ্নে দক্ষিণ আফ্রিকা রাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করিয়াছিল, তাহাকে বলা হয় ‘রেস্টোরেটিভ জাস্টিস’। অর্থাৎ, অত্যাচারী ও অত্যাচারিতকে মুখোমুখি বসাইয়া গণশুনানির ব্যবস্থা, যাহাতে শাস্তিদান অপেক্ষাও অত্যাচারের স্বীকৃতিই প্রধান কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নুরেমবার্গ ও টোকিয়ো বিচারপর্বে দণ্ড ঘোষণাই ছিল মুখ্য, তাহাও আবার বিশ্বরাজনীতি তথা কূটনীতির অঙ্কে। সোভিয়েটোত্তর ইস্টার্ন ব্লকেও কমিউনিস্ট জমানার অত্যাচারের সুবিচার হয় নাই, যাহা দেখা গিয়াছিল তাহা প্রতিশোধস্পৃহা, প্রকৃত অত্যাচারীরাও নূতন ব্যবস্থায় পুনর্বাসন খুঁজিয়া লইয়াছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার নজিরমূলক সুবিচার দানের জন্য যে সংস্থা গড়িয়া উঠিয়াছিল— ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন— তাহার সভাপতি ছিলেন টুটু। সত্যান্বেষণ এবং সমাজ পুনর্গঠনে পথ দেখাইয়াছেন তিনি। ন্যায়পরায়ণ রাজনীতির জোরে, সমাজের কল্যাণ আকাঙ্ক্ষার জোরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Desmond Tutu south africa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE