নাগরিক সমাজই যুদ্ধের নূতন সীমান্ত, কারণ তাহাকে ব্যবহার করিয়া এবং তাহার বিকার ঘটাইয়া জাতীয় স্বার্থে আঘাত করা যায়— এমন একটি প্রতর্কের ফানুস সম্প্রতি ভারতের আকাশে উড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। বিচিত্র এবং উৎকট ধারণাও গণতান্ত্রিক দেশে উড়িতেই পারে, তাহা লইয়া তর্কবিতর্ক চলিতেই পারে। কিন্তু দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যদি জাতীয় পুলিশ অ্যাকাডেমির নবীন অফিসারদের উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় সিভিল সোসাইটিকে প্রতিরক্ষার নূতন অঙ্গন হিসাবে চিহ্নিত করেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসের জুজু দেখাইয়া তাহাকে ‘অন্তর্ঘাত ও বিভাজন’-এর সম্ভাবনা হইতে রক্ষা করিবার দায়িত্ব পুলিশের হাতে অর্পণ করেন, তাহা গভীর উদ্বেগের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। উদ্বেগ ইহাই যে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল তাঁহার ভাষণের মধ্য দিয়া যুগপৎ দুইটি সঙ্কেত দিতে চাহিয়াছেন। প্রথমত, পুলিশ তথা নিরাপত্তা বাহিনীকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নামে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে দমনে ‘তৎপর’ হইবার সঙ্কেত; দ্বিতীয়ত, নাগরিক সমাজকে রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করিবার আকাঙ্ক্ষা দমন করিবার, অর্থাৎ শাসকের ‘অনুগত’ থাকিবার সঙ্কেত। স্পষ্টতই, দুইটি সঙ্কেত দুই চরিত্রের: প্রথমটি ছাড়পত্র, দ্বিতীয়টি হুঁশিয়ারি। দুইয়ে মিলিয়া এক ভয়ঙ্কর আশঙ্কা জাগিয়া উঠে। গণতন্ত্রের শ্বাসরোধের আশঙ্কা।
যে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান যন্ত্রীদের পরম বিশ্বস্ত বলিয়া অজিত ডোভাল পরিচিত, তাহার আচরণ দেখিয়া প্রতিনিয়ত ধারণা হয় যে, সমস্ত প্রতিবাদ ও প্রশ্নকে তাহারা রাষ্ট্রদ্রোহ বলিয়া মনে করে, যে কোনও বিরোধিতাকে দমন করিবার ব্যগ্রতায় গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্ত লঙ্ঘনেও তাহার আপত্তি নাই। শাসকের অ-গণতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের এমন অজস্র নজির ধারাবাহিক ভাবে তৈয়ারি হইয়া আসিতেছে যে তাহার তালিকা রচনা কার্যত অসম্ভব, অনাবশ্যকও। কেবলমাত্র বিদেশের মাটিতে দাঁড়াইয়া ‘দুই ভারত’ বিষয়ে তীব্র কিছু মন্তব্য করিবার ‘অপরাধ’-এ বীর দাসের উপরে উগ্র-জাতীয়তার লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণ নামিয়া আসিয়াছে, শাসকরা যথারীতি সেই বিষয়ে মৌন অবলম্বন করিয়া তাহাকে প্রশ্রয় দিয়াছেন। একটি দৃষ্টান্তই আশঙ্কার মাত্রা উপলব্ধি করিবার জন্য যথেষ্ট। ডোভালের যুদ্ধ-ঘোষণায় যদি লাঠিয়ালরা নূতন উদ্দীপনার কারণ খুঁজিয়া পায়, বিস্ময়ের কিছু থাকিবে কি?
নাগরিক সমাজের ‘রণাঙ্গন’ লইয়া নিরাপত্তা উপদেষ্টা কেন এতটা ভাবিত বা ভাবিতে আদিষ্ট হইলেন? লক্ষণীয়, বিরোধী রাজনীতিকে দুর্বল ও বিভক্ত করিবার জন্য শাসকদের চেষ্টার কোনও বিরাম নাই। তাহার জন্য অর্থের লোভ, ক্ষমতার আকর্ষণ, প্রশাসনিক তদন্ত ও হানাদারির ভয় এবং মামলার চাপ— ছল-বল-কৌশলের কোনও ঘাটতি রাখা হয় নাই। সেই উদ্যোগ অনেকাংশে সফলও বটে— বিরোধী শিবির এখনও দুর্বল, বিভক্ত, বিস্রস্ত। তাহার অনেকটাই বিরোধী দলগুলির নিজকীর্তি, কিন্তু শাসকের চালগুলিকেও তুচ্ছ করিবার উপায় নাই। এই অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বালাইয়া চলিয়াছে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন স্তর হইতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ এবং প্রতিস্পর্ধা। কৃষক আন্দোলন এই মুহূর্তে তাহার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত, কিন্তু দৃষ্টান্ত আরও আছে। আছে বলিয়াই শাসকদের মুখে ‘আরবান নকশাল’, ‘আন্দোলনজীবী’ ইত্যাদি গালিগালাজের অন্ত নাই। আছে বলিয়াই প্রতিবাদীদের উপর চণ্ডনীতি প্রয়োগে বিরাম নাই, আছে বলিয়াই ডোভাল পুলিশকে নূতন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইতে বলিতেছেন। তাঁহারা হয়তো ভাবিতেছেন, আধিপত্য নিরঙ্কুশ করিবার অভিযানে নাগরিক সমাজই প্রতিরোধের শেষ সীমান্ত। অশ্বমেধের ঘোড়াকে তাহারাই রুখিয়া দিতে পারে। শাসকের ভাবনাই বুঝাইয়া দেয়, নাগরিক সমাজই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভরসা। হয়তো শেষ ভরসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy