এক রাজ্য, এক আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক’ নীতি কার্যকর হল ১ মে থেকে। সেই অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের দু’টি আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক (আরআরবি)— পশ্চিমবঙ্গ গ্রামীণ ব্যাঙ্ক এবং উত্তরবঙ্গ ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ ব্যাঙ্ক— মিশে গেল বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কে। শেষেরটির ‘স্পনসর ব্যাঙ্ক’ যে-হেতু পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, তাই পিএনবি-র আওতাতেই সামগ্রিক ভাবে আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা কাজ করবে পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আরও দশটি রাজ্যে একাধিক আরআরবি মিলিত হয়েছে একটির সঙ্গে। যার ফলে সারা দেশে তেতাল্লিশটি আরআরবি কমে দাঁড়িয়েছে আটাশটিতে। আরআরবি-র বিশেষত্ব এই যে, এগুলি বিশেষ ভাবে গ্রামীণ এলাকার মানুষকে ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত করতে, এবং গ্রামবাসীর শিক্ষা, আবাস, স্বচ্ছ জ্বালানি, স্বরোজগার, ব্যবসায়িক উদ্যোগ প্রভৃতির জন্য টাকার জোগান দিতে দায়বদ্ধ। এই ধরনের ক্ষেত্রগুলিকে ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ‘অগ্রাধিকার ক্ষেত্র’ বলে চিহ্নিত করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যেখানে এই সব ক্ষেত্রে অন্তত ৪০ শতাংশ ঋণ দিতে বাধ্য, সেখানে আরআরবি ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ ঋণ দেয় এই ক্ষেত্রগুলিকে। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুদান, সরকারি প্রকল্পে কাজের বেতন, পেনশন প্রভৃতি সহায়তা গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রধান উপায় আরআরবি। অতএব আরআরবি-সম্পর্কিত নীতি গ্রামীণ ব্যাঙ্ক পরিষেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থার সামগ্রিক চিত্রটির নিরিখে এই সংযুক্তিকরণকে স্বাগত জানাতেই হয়। প্রধান যুক্তি অবশ্যই মূলধন বৃদ্ধি। ব্যাঙ্ক দুর্বল হয়ে পড়লে তার প্রতি আস্থা ফেরাতে সরকারকে মূলধন জোগাতে হয়। ১৯৭৫ সালে আরআরবি-র জন্মলগ্ন থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সরকার এই ব্যাঙ্কগুলিকে আটাশ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূলধন জুগিয়েছে। তদুপরি ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩, এই দুই অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় এগারো হাজার কোটি টাকা মূলধন জোগান দিয়েছে এই ব্যাঙ্কগুলিকে। এই সহায়তায় আর্থিক স্বাস্থ্য অনেকটাই ফিরেছে এই ব্যাঙ্কগুলির, তবুও ঋণখেলাপি, মন্দ প্রশাসন, নিম্ন প্রযুক্তির সঙ্কট সম্পূর্ণ কাটেনি। দরিদ্র মানুষ, ক্ষুদ্র উদ্যোগ প্রধান লক্ষ্য হওয়ায় আরআরবিগুলির পক্ষে লাভজনক হওয়া সহজ নয়। কৃষিঋণ মকুবের নীতির জেরেও বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই ব্যাঙ্কগুলি। উপরন্তু, এখন বিভিন্ন প্রাইভেট ব্যাঙ্ক, বেসরকারি ঋণ প্রদান সংস্থা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে। মোবাইল ব্যাঙ্কিং, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং, ইউপিআই প্রভৃতি পরিষেবায় পিছিয়ে রয়েছে আরআরবি। ব্যাঙ্কের সংখ্যা কমিয়ে আনলে নানা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি প্রতিষ্ঠানে মূলধন সংহত হয়, ব্যাঙ্ক শক্তিশালী হয়, রাজকোষের ব্যয়ভার কমে, ডিজিটাল পরিকাঠামো-সহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সম্ভব হয়। ২০১৫ সালে কেন্দ্র আরআরবি-কে ক্ষমতা দিয়েছে বাজার থেকে মূলধন তোলার। ব্যাঙ্ক শক্তিশালী হলে কাজটি সহজ হবে। আরআরবি-র সমৃদ্ধি গ্রামীণ অর্থব্যবস্থার জন্য সুখবর।
তবে মনে রাখতে হবে তার বৈশিষ্ট্যের দিকটাও। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক এবং সমবায় ব্যাঙ্কের বাইরে এক ধরনের ব্যাঙ্কের প্রয়োজন আছে যা বিশেষ ভাবে গ্রামের আর্থিক ক্ষেত্রের প্রয়োজন মেটাবে, সেই ধারণা থেকে সত্তরের দশকে আরআরবি ব্যবস্থা শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সারা দেশে ১৯৬টি আরআরবি ছিল, ধাপে ধাপে কমে যা এখন দাঁড়াল আটাশে। সুলভ ব্যাঙ্কিং পরিষেবার প্রসারের প্রয়োজন কিন্তু কমেনি। তার জন্য ব্যাঙ্ক-কর্মীদের গ্রামবাসীর সঙ্গে নিবিড় সংযুক্তি প্রয়োজন। অথচ, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, গত এক দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী সংখ্যা কমছে, বেসরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী দ্রুত বেড়ে এখন ছাড়িয়ে গিয়েছে সরকারি কর্মীদের। ব্যাঙ্কের শক্তিবৃদ্ধি যদি তার প্রধান লক্ষ্য— অর্থাৎ, প্রান্তিকের ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি— সফল করে, তবেই তা সার্থক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)