ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাষা হিসাবে বাংলা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই স্বীকৃতি লাভ করতে গেলে ঐতিহাসিক প্রাচীনত্বের গুরুত্ব, সাহিত্যিক ঐতিহ্যের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র, ভবিষ্য ব্যবহারের সম্ভাবনা ইত্যাদি নানা নিক্তিতে উত্তীর্ণ হতে হয়। বাংলা ভাষা সেগুলিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এ নিশ্চয়ই এক গৌরবমুহূর্ত। মনে পড়তে পারে, ঔপনিবেশিক কালপর্বে ইংরেজ প্রশাসকদের উদ্যোগে ভারতীয় ভাষাগুলির শুমারি যখন গৃহীত হল তখন ইংরেজ প্রশাসকরা বাংলা ভাষাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন। জন বিমস বাংলা যে অপরাপর ভারতীয় ভাষার চাইতে অগ্রসর, ইউরোপীয় ভাষার তুল্য, তা জানিয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বিমসের রচনার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন। উনিশ শতকে বঙ্কিম একক সামর্থেই প্রায় বাংলা গদ্যের নবযুগ এনেছিলেন। সেই উত্তরাধিকার রবীন্দ্রনাথে সম্প্রসারিত হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষে ‘বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব লিটারেচার’ নামক সাহেবি প্রতিষ্ঠান স্বাজাতিক উদ্দেশ্য নিয়ে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’-এ রূপান্তরিত হয়েছিল। এই পরিষদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গভাষার অতীত ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার। পদাবলি সাহিত্য-পূর্ব বঙ্গভাষার নিদর্শন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করলেন। বসন্তরঞ্জন খুঁজে পেলেন বাংলা ভাষায় লেখা চৈতন্য-পূর্ববর্তী রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক আখ্যানকাব্য কৃষ্ণকীর্তন। নীহাররঞ্জন রায় বাঙালির ইতিহাসের যে আদিপর্ব রচনা করেছিলেন সেই পথ বেয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এক অর্থে এই অনুসন্ধানের অংশীদার। এই সমস্ত অনুসন্ধানের আবহেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচনা করেছিলেন তাঁর মহাগ্রন্থ দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ। কেবল বাংলা ভাষার প্রাচীনতাইপ্রতিষ্ঠিত হল না, আধুনিকতাও তৈরি হল। রবীন্দ্রনাথ নিজের অনূদিত ইংরেজি কবিতার জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন: এশিয়ার মধ্যে প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের লেখার ভাষা দাঁড়াল বাংলা। বিশ শতকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় স্নাতকোত্তর পড়ানো শুরু হল। বাংলা বানান ও পরিভাষা সংস্কারে ও সঙ্কলনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ গ্রহণকরল। রাজ্য উচ্চ শিক্ষা জফতরের অধীন ইনস্টিটিউট অব ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ় যে দাবিপত্র তৈরি করেছিল, তার জোরেই আজকের এই স্বীকৃতি এল, যার মধ্যে মিশে আছে এই সমস্ত অতীত শ্রম ও উদ্যোগের সুফল।
প্রশ্ন হল এই ধ্রুপদী স্বীকৃতি নিয়ে এখন বাংলাভাষীরা কী করতে পারেন? প্রথম কথাই হল, বাংলা ভাষার প্রতি যে অশ্রদ্ধা ও অযত্ন এখন সর্বত্র দৃশ্যমান, তার থেকে একটুও বেরোনো যাবে কি? যোগ্য ভাষা হিসাবেই বাংলা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে এই শ্রদ্ধাবোধ থেকে ভাষার প্রতি যত্ন ও মনোযোগ ফিরে আসবে কি? অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা থেকে যদি কর্মতৎপরতা জেগে ওঠে তা হলেই এই ভাষার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে, তবে সত্যি বলতে, সেই আশা নেহাতই ক্ষীণ। এই ক্ষীণ আশাটুকু সম্বল করেই বাংলা ভাষাকে সর্বক্ষেত্রে সহজে ব্যবহার করার উপায় কী, সেই প্রচেষ্টায় শামিল হওয়া জরুরি। এই রাজ্যের অসংখ্য সাধারণ মানুষ তাঁদের বাংলা ভাষা জানার সুবিধাটুকু যাতে কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসনকে নিতে হবে। যে বাংলা আকাদেমি এ রাজ্যে রয়েছে তা কেবল পুরনো বই ছেপে আর পুরস্কার প্রদান করে তার সময়-সামর্থ্য ফুরিয়ে ফেললে কী হবে? ভাল অভিধান কোথায়? পরিভাষা তৈরি হল কোথায়? সর্বত্র যাতে বাংলা ব্যবহার করা যায় তার জন্য উপযুক্ত শব্দব্যবস্থা নির্মাণে গুণিজনদের নিয়োগ করতে হবে, সেই প্রয়াস কোথায়?
সংবাদে প্রকাশ বাংলা ভাষা ধ্রুপদীর গুরুত্ব পাওয়া মাত্র দুর্গাপুজোর পূর্বমুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী উৎসাহ প্রকাশ করেছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভাল কথা, তবে ভাষার স্বীকৃতি রাজনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তির উপায় হিসাবে ব্যবহৃত হলে তা আনন্দের নয় উদ্বেগের কারণ। এ দেশে ভাষা-রাজনীতির নানা চেহারা। শুধু এটুকুই বলার, ভাষা সাংস্কৃতিক পণ্য নির্মাণের, জ্ঞানচর্চার উপায়। অনুশীলন ও শ্রম, ভালবাসা ও যত্ন এর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। রাজনৈতিক অভিনন্দন ভাল, তবে তার উপর নির্ভর না করে সর্বস্তরের বাঙালি ভাষার প্রতি ঈপ্সিত যত্ন, মনোযোগ গ্রহণ করলে এই ভাষার ধ্রুপদী অবয়ব ব্যবহারযোগ্য ও অর্থময় হয়ে উঠতে পারে। বাঙালি সে কাজ করবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy