অপুষ্টি, ক্ষুধা, লিঙ্গবৈষম্য— যে সঙ্কটগুলি মানব উন্নয়নের নিরিখে বিশ্বে শেষ সারিতে ঠেলে দিয়েছে ভারতকে, তার কোনওটি তেমন গুরুত্ব পেল না বাজেটে। শিশুদের জন্য সামগ্রিক বরাদ্দ মোট বাজেটের আড়াই শতাংশও স্পর্শ করেনি। দরিদ্র শিশুর খাবারের বরাদ্দে সরকারের কার্পণ্যের ধারা অব্যাহত। মিড-ডে মিল, এখন যার পোশাকি নাম ‘পিএম-পোষণ’ প্রকল্প, তাতে বরাদ্দ বেড়েছে দেড়শো কোটি টাকা (০.২৬ শতাংশ)। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি, এবং প্রাপকের সংখ্যা (আট কোটি শিশু, এক কোটি গর্ভবতী ও সদ্যপ্রসূতি মহিলা, কুড়ি লক্ষ কিশোরী) বিচার করলে বোঝা যায়, ওই ‘বাড়তি’ বরাদ্দ শিশুর বাড়তি পুষ্টির ব্যবস্থা করতে পারবে না। ভারতের পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের ৩৫ শতাংশ পুষ্টির অভাবে বেঁটে থেকে যাচ্ছে (স্টান্টেড), এই চিত্র গত পনেরো বছর ধরে প্রায় এক। অপুষ্টি কমছে, এমন কোনও আশ্বাস দিতে পারেনি জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষাগুলি, পাঁচ বছর অন্তর যা শিশু ও মেয়েদের স্বাস্থ্যের খবর দেয়। ২০২১ সালে ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ এবং ‘পোষণ ২’ প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০২৫ সালকে লক্ষ্য করে। শিশু অপুষ্টির লক্ষণগুলি (কম ওজন, কম উচ্চতা প্রভৃতি) প্রতি বছর দু’শতাংশ কমানো, এবং রক্তাল্পতা বছরে তিন শতাংশ কমানোর অঙ্গীকার করেছিল। অথচ, এই ক’বছরে যেমন নামমাত্র বেড়েছে শিশুর খাদ্যের বরাদ্দ, তেমনই অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ভাতা যথাপূর্বং। অন্তহীন অপুষ্টি কিংবা মহিলা-কর্মীদের যৎসামান্য ভাতা, এগুলো যেন কেন্দ্রীয় সরকারের নজরের যোগ্যই নয়।
তাতে আক্ষেপ যতই থাক, আশ্চর্য হওয়া চলে না। সমাজকল্যাণ, নারী ও শিশু কল্যাণ প্রভৃতি দফতরগুলিতে বাজেটের কাটছাঁট প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো সেই দৈন্য ঢাকা দেওয়ার জন্যই প্রায় প্রতি বছর কোনও না কোনও নতুন প্রকল্পের ঘোষণা হয়। নভেম্বর ২০২৩-এ যেমন ঘোষিত হয়েছিল ‘পিএম জনমন’ (প্রধানমন্ত্রী জনজাতি আদিবাসী ন্যায় মহা অভিযান)। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে বিশেষ ভাবে বিপন্ন পঁচাত্তরটি জনজাতি গোষ্ঠীর জন্য এই প্রকল্পে একশো কুড়ি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এতে জনজাতির উন্নয়নের যে আশা জাগে, তা নিবু-নিবু হয়ে আসে যখন দেখি তফসিলি জনজাতিদের জন্য প্রি-ম্যাট্রিক স্কলারশিপে ২৮ শতাংশ বরাদ্দ কমেছে, চারশোটি একলব্য আবাসিক স্কুলের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ। ‘পিএম-শ্রী’ প্রকল্পের অধীনে উন্নততর স্কুলের জন্য বরাদ্দ ২৪ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু ‘পিএম-যশস্বী’ প্রকল্প, যা উৎকৃষ্ট স্কুলের সহায়তার জন্য শুরু হয়েছিল, তার বরাদ্দ কমেছে ৩৩ শতাংশ। এ যেন এক হাতে দিয়ে অন্য হাতে ছিনিয়ে নেওয়ার খেলা। এই হাতসাফাই উদ্বেগ জাগায়, যখন দেখা যায় যে সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের পোস্ট-ম্যাট্রিক স্কলারশিপ, মাদ্রাসা শিক্ষা প্রভৃতি খাতে বরাদ্দ বেশ খানিকটা কমেছে। কিংবা শিশুদের যৌন হয়রানি, শিশু পাচার নিয়ে উদ্বেগ যখন বাড়ছে, তখন ‘মিশন বাৎসল্য’-তে মোট বরাদ্দ মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা। অথচ, শিশুরা ভারতের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।
প্রশ্ন কেবল বরাদ্দ নিয়েই নয়, খরচ নিয়েও। নারী কল্যাণের প্রকল্পগুলিকে ‘মিশন শক্তি’ নামে ছাতার তলায় আনা হয়েছে। মোট বরাদ্দ নামমাত্র বেড়েছে, তা-ই শুধু নয়, চলতি অর্থবর্ষের বরাদ্দের একটা বড় অংশ খরচ হয়নি। ‘সম্বল’ প্রকল্পে (মেয়েদের হেল্পলাইন, ওয়ান স্টপ সেন্টার, নারী আদালত, ইত্যাদি) বরাদ্দ ছ’শো কোটি টাকার এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয়নি। মেয়েদের হস্টেল, আপৎকালীন আশ্রয়, ক্রেশ প্রভৃতির জন্য ‘সামর্থ্য’ প্রকল্পে বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকার অর্ধেকও খরচ হয়নি। এই কি মেয়েদের শক্তি বৃদ্ধির নমুনা? বরাদ্দ খরচের উপযুক্ত ব্যবস্থা তৈরির সময়, অর্থ, পরিকল্পনার প্রয়োজন। নানা স্তরের আধিকারিকদের সমন্বয় দরকার। সে ব্যবস্থা না করে বছর-বছর বাজেটে সমাজকল্যাণ খাতে কিছু সংখ্যা লিখে দেওয়া প্রতারণার শামিল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)