ছোট মাপের লক্ষ্যও অনেক সময় বড় মাপের ফলাফল তৈরি করে। জাত-শুমারি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন তেমনই একটি ঘটনা। অনেক দিনের টালবাহানা এবং সক্রিয় প্রতিরোধের পর কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার জাতশুমারি ঘোষণা করেছে। পিছু-ফেরার সিদ্ধান্ত, সন্দেহ নেই। বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০২৩ সালেই মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের গৌরবে স্নাত হতে হতে প্রধানমন্ত্রী মোদী জাতগণনা বিষয়ে দেশের তামাম বিরোধী দলকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। বলেছিলেন, জাতের হিসাব চেয়ে বিরোধীরা দেশকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন। বলেছিলেন, তাঁর কাছে জাত মাত্র চার প্রকার, নারী, তরুণ, কৃষক ও দরিদ্র। এই চারটি গোষ্ঠী কী ভাবে বাধ্যত পরস্পর-বিযুক্ত— তার উত্তর অবশ্যই তিনি দেননি। ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্টে একটি হলফনামা পেশ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার, যাতে বলা হয়েছিল তফসিলি জাতি ও জনজাতি ছাড়া আর কোনও জাতপরিচিতি আলাদা করে জনগণনায় স্বীকৃতি না দেওয়া— ‘সচেতন সরকারি সিদ্ধান্ত’। সুতরাং সাম্প্রতিক ঘোষণাটি আক্ষরিক অর্থে ‘ইউ-টার্ন’। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ মনে করিয়েছেন, ২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল একটি টিভি সাক্ষাৎকারে নরেন্দ্র মোদীর মুখে এও শোনা গিয়েছিল, জাতগণনার দাবি যাঁরা তোলেন, তাঁরা ‘আরবান নকশাল’।
ভারতীয় জনসমাজের বৈচিত্র ও সত্তাপরিচিতির বিপুল বিভিন্নতার সঙ্গে যে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ঘনিষ্ঠ সংযোগ, এবং সেই সংযোগের মূল সূত্রটি যে জাতপরিচয়ের মধ্যেই বিধৃত, ভারতীয় রাজনীতিতে তা এত দিনে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। তবে সত্য হলেও বিষয়টির জটিলতা এমন বহুমাত্রিক যে নানা কারণেই এতে অগ্রসর হওয়া যায়নি। জাতসম্পর্কিত যে কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ভিত্তি থেকে গিয়েছিল ১৯৩১ সালের সেন্সাস। তবে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলের কাছে বিষয়টিতে অন্য কোনও জটিলতা নেই— তাঁরা সামগ্রিক ভাবে জাতগণনা বিষয়টির গুরুত্বই অস্বীকার করতে চান কেননা ‘হিন্দু সমাজ’ বলতে তাঁরা যে ধারণা তৈরি করতে চান, জাতের ভিত্তিতে তা খণ্ডীকৃত হয়ে যাওয়ার ঘোরতর সম্ভাবনা। এই কারণেই ২০১১ সালের জনশুমারির সঙ্গে যে জাতভিত্তিক তথ্য সংগৃহীত হয়েছিল, মোদী সরকারের আমলে তা প্রকাশ্য করা হয়নি। তবে আজ এই ‘ইউ-টার্ন’ কেন?
যতই বিরোধীদের গাল দিন, প্রধানমন্ত্রী মোদী নিশ্চয় জানেন যে রাহুল গান্ধী প্রমুখ যে ভাবে জাতগণনার প্রশ্নের সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নের সঙ্গে মিলিয়ে প্রচার করছেন, তা তাঁদের বড় সমস্যায় ফেলতে পারে, বিশেষত বিহার নির্বাচনে। বিহারের যে কোনও ভোটে জাত-প্রশ্নটি বৃহত্তম নির্ধারক, এবং বিহারের মু্খ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার কেন্দ্রীয় এনডিএ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ— প্রায় নির্ধারক— শরিক। প্রসঙ্গত, জাতগণনার প্রশ্নকে তাঁর রাজ্যে এড়ানো যাবে না বলেই বিহারে নীতীশ কুমার ২০২২ সালে রাজ্যভিত্তিক জাতগণনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এখন বিধানসভা নির্বাচনের আগে যদি এই প্রশ্ন উপেক্ষিত হয়, তা হলে নীতীশ কুমার তথা নরেন্দ্র মোদী বিষম বিপন্ন হতে পারেন। এমনিতেই সংরক্ষণের প্রশ্নে তথাকথিত নিচু জাতের পরিস্থিতি খুব ভাল নয়, প্রথমত অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল গোষ্ঠীর সংরক্ষণের প্রথা চালুর ফলে (যা বকলমে উচ্চজাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য), এবং দ্বিতীয়ত উচ্চ সরকারি পদে নিচু জাতের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বের অভাবের কারণে। তবে সমস্ত নির্বাচনী স্বার্থ ও হিসাবের কথার উপরে আরও একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক বাস্তব থাকে, যা আর্থ-সামাজিক ন্যায়ের প্রেক্ষিতে জাতগণনা দাবি করে। সে দিক থেকে মোদী সরকারের পিছু-ফেরা— ষোলো বছর পর ২০২৭ সালে দুই পর্বে জাতগণনার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ— বিশেষ অভিনন্দনযোগ্য। আরও একটি অভিনন্দন প্রাপ্য হবে, জাতগণনার ফলাফল সুষ্ঠু ভাবে প্রকাশিত হলে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)