E-Paper

কোন অভিমুখে

দুর্নীতিতে বা অন্য বড় অপরাধে অভিযুক্ত হলে নৈতিক দায় স্বীকার করে ইস্তফার রেওয়াজ ভারতীয় রাজনীতিতে নেই, ফলে রাজনীতি ও প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করতে আইনের প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই।

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৫ ০৫:২৯

অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই শাস্তি বিধান করার প্রচলন যে দেশের বিচারপদ্ধতিতে নেই, সেই দেশে কি কোনও অভিযুক্ত মন্ত্রী তথা জননির্বাচিত প্রতিনিধির অপরাধ প্রমাণ অবধি অপেক্ষা না করেই তাঁকে পদ থেকে অপসারণ করা যেতে পারে?—গুরুতর প্রশ্ন। এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে হলে, বিভিন্ন মতের বিনিময়, আলাপ-আলোচনা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অথচ তেমন কোনও আলোচনা বিবেচনা ছাড়াই গত বুধবার সংসদে এই মর্মে বিল পেশ করা হয়ে গেল। দুর্নীতিতে বা অন্য বড় অপরাধে অভিযুক্ত হলে নৈতিক দায় স্বীকার করে ইস্তফার রেওয়াজ ভারতীয় রাজনীতিতে নেই, ফলে রাজনীতি ও প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করতে আইনের প্রয়োজন রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু সেই সঙ্গে, প্রতিহিংসা-সর্বস্ব হয়ে ওঠা ভারতীয় রাজনীতিতে বিপক্ষকে কোণঠাসা করার অস্ত্র হিসাবে এমন আইন যাতে ব্যবহার না করা যায়, তা দেখাও বিশেষ জরুরি। সে দিক থেকে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নতুন বিলটি একেবারেই একপেশে— বাস্তবিক তা ভারতীয় রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রেই আঘাত হানতে পারে। ফলে সংসদে বিরোধী নেতৃবর্গের যে সম্মিলিত প্রতিবাদ দেখা গেল, তাকে কুনাট্য বলে দেখার অবকাশ নেই— তাঁদের উষ্মা ও উত্তেজনা সহজবোধ্য। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এত গুরুতর একটি প্রশ্নেও সংসদীয় রীতিনীতি সমূলে বিসর্জন দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসক পক্ষ সোজাসুজি বিল প্রস্তুত ও উত্থাপন করল— অতীব দুর্ভাগ্যজনক। এই বিল অনুযায়ী, ৩০ দিনের জেলবাসের পর অভিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি করা হবে রাজ্যপাল পদটির মাধ্যমে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শাসকের বিরোধী দলগুলি যে যে রাজ্যে ক্ষমতাসীন, সেখানে এই পদ্ধতিতে মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীকে সরানো হতে পারে, এমন আশঙ্কা কেউ করলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। মূল প্রস্তাবে যদিও প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিষয়েও এই সম্ভাবনা খোলা রাখা আছে, কেন্দ্রীয় শাসকের বিবেচনায় যে কেন্দ্রীয় শাসক নিজেই পদচ্যুত হবেন না— এ যে কেবল কথার খেলা, তা বোঝা সহজ। বিরোধীদের বিপুল প্রতিরোধের মধ্যেও এই বিল শেষ অবধি নিরাপত্তা রক্ষী বলয়ের মধ্যে থেকে যে ভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পেশ করলেন, সেই প্রক্রিয়া কোনও মতেই সংসদীয় গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়।

এই বিল নিয়ে এখনও অনেক রাজনৈতিক জলঘোলা বাকি। কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য কি বিরোধী-কথিত ‘নাৎসি বাহিনীর গেস্টাপো বাহিনী ও পুলিশ স্টেট’ তৈরি, না কি বিজেপি-দাবিমতো দুর্নীতিমোচনের ব্রত, তা নিয়ে বিস্তর চাপান-উতোর শোনা যাবে। তবে, বিরোধী নেতারা সঙ্গত ভাবেই নির্দেশ করেছেন, যে সংবিধান সংশোধনী প্রয়োজন এর জন্য, সরকারের পক্ষে তা সহজ নাও হতে পারে। এও ধরে নেওয়া যায়, যদিও নাগরিক রাজনৈতিক সচেতনতা আজকাল সাধারণত সমাজমাধ্যমেই আবদ্ধ-নিবদ্ধ থাকে, তবু তাঁদের অন্তত একাংশ বুঝবেন বিষয়টির গুরুত্ব। কেবল সংসদীয় রাজনীতিতে নয়, তার বাইরে বৃহত্তর রাজনীতির অঙ্গনেও এ নিয়ে আলোচনা ও মতের আদানপ্রদান হওয়া বাঞ্ছনীয়, কেননা, স্বাভাবিক বুদ্ধি বলে, এত বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীয় শাসকের হাতে কুক্ষিগত হওয়া যুক্তরাষ্ট্র, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সব কিছুর জন্যই অতীব বিপজ্জনক।

কিছু দিন আগেই জরুরি অবস্থার অর্ধশতক পালন হল, জরুরি অবস্থা ঘোষণার দিনটির সংবিধান-হত্যা দিবস নামকরণ হল। দুই মাসের মধ্যেই কিন্তু সরাসরি সেই সংবিধান-অতিক্রমী কেন্দ্রীভূত শাসনের দিকেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের অভিমুখ। এক দিকে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়ায় নাগরিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘন, অন্য দিকে নবতম বিলের মাধ্যমে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ— এই যৌথ অ্যাজেন্ডা অতীব উদ্বেগের। চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত এই অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কা মুক্ত গণতন্ত্রের পরিপন্থী।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

NDA INDIA Alliance New Bill

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy