E-Paper

অনভিপ্রেত

ভারতে শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও আইনের শাসনের কথা বলা হলেও, বাস্তবে সেই গণতান্ত্রিক পথ বেয়েই কিছু মানুষের হাতে ‘ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা’ এসে পড়ে।

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫ ০৬:১০

সরকার, শাসনতন্ত্র, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি— ঠিক সময়ে সবাই যদি ঠিক কাজটা করে, তা হলেই সমস্যা থাকে না। সমস্যা হয় এই ব্যবহারিক সত্যের দিকে নজর না দিলে, দীর্ঘসূত্রতায় সময় বইয়ে দিলে— পরে তা হয়ে ওঠে অসুবিধা। ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মাননীয় ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের দিল্লির বাংলো নিয়ে এই মুহূর্তে যা ঘটে চলেছে তা একই সঙ্গে বিস্ময় ও অস্বস্তির, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের তরফেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি গিয়েছে যাতে ওই বাড়িটি অবিলম্বে খালি করানোর ব্যবস্থা করা হয়। সমস্যা অবসরের পরে নিয়মনির্দিষ্ট সময় পেরিয়েও অতিরিক্ত সময় বাংলোয় থেকে যাওয়া নিয়ে, ইতিমধ্যে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি যার কারণও দেখিয়েছেন: তাঁর বিশেষ ভাবে সক্ষম দুই দত্তক-কন্যার চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধাযুক্ত যেমন বাড়ি প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না বলেই বাড়ি ছাড়া যাচ্ছে না; প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হিসাবে অন্য যে বাংলোটি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট, সেটিরও সংস্কারকাজ শেষ হয়নি ইত্যাদি।

পুরো ঘটনাটিই অনভিপ্রেত। সমস্যা যখন একটি নিয়ম ও তার লঙ্ঘন ঘিরে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বৃত্তেই নিশ্চিত ভাবে তার ফয়সালা করা যেত। ঘটনাটি ঘিরে জনপরিসরে এখন যে ভাবে পক্ষে ও বিপক্ষে, সমর্থন বা নিন্দায় নানা যুক্তি, অনুমান ও ইঙ্গিত পল্লবিত হয়ে উঠছে তা খুব সুস্থ চর্চা নয়। আবার এই সব কিছুই এক জন সম্মাননীয় মানুষের অবসর-উত্তর বিড়ম্বনা, ইচ্ছাকৃত ভাবে তৈরি করা অনাদর, এমন মনে হওয়াও অমূলক নয়। এই সে-দিনও দেশের বিচারবিভাগের শীর্ষপদে আসীন মানুষটিকে আজ এক নিয়মলঙ্ঘনের ব্যাখ্যা হিসাবে নিকটজনের শারীরিক দুরবস্থা তুলে ধরতে হচ্ছে, এতেও সহানুভূতি জাগতে পারে: নেহাত একটি বাড়িরই তো ব্যাপার, আর একটু সময় দিলে সুপ্রিম কোর্টই হোক বা কেন্দ্র, কারও খুব অসুবিধা হত কি!

একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে, এ কারও সুবিধা-অসুবিধার প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটি নিয়ম ও তার লঙ্ঘনের, আরও স্পষ্ট ভাবে বললে ক্ষমতা বনাম আইনের। এই ঘটনার চুম্বকে এক বৃহত্তর সমস্যার দিকেও নজর পড়ে, সেটি ক্ষমতাতন্ত্রের সমস্যা। ভারতে শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও আইনের শাসনের কথা বলা হলেও, বাস্তবে সেই গণতান্ত্রিক পথ বেয়েই কিছু মানুষের হাতে ‘ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা’ এসে পড়ে। নাগরিকদের ভোটেই কোনও দল ক্ষমতায় আসে, তাদের গড়া সরকার ও তার শাসন-কাঠামোর নানা স্তরে থাকা শীর্ষস্থানীয়দেরই ক্রমে ক্ষমতার জোরে আইন লঙ্ঘন করতে দেখা যায়। এই লঙ্ঘনের নানা রূপ: কখনও দুর্নীতি, কখনও দমন নীতি, কখনও ক্ষমতাবলে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভ্যাসকে ‘অধিকার’ মনে করে তার অপব্যবহার। প্রথম দু’টি সমাজে ও রাজনীতিতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে, কিন্তু তৃতীয়টি চলে ক্ষমতার ভাঁজে ভাঁজে, প্রশাসন ও আইনকে পকেটে পুরে। শাসনতন্ত্রের এই দুর্দিনে বিচারবিভাগই নাগরিকের বলভরসা, কারণ তাঁদের কাছে বিচারব্যবস্থায় উচ্চাসীনেরা আইন ও ন্যায়ের রক্ষক, সঙ্কীর্ণ সুবিধাভোগী নন। বিচারবিভাগের রায় নিয়ে নাগরিকের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু নীতিপরায়ণতা ও নিয়মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার প্রতিনিধিদের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস অটল। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির ঘটনায় নিয়ম লঙ্ঘনের প্রশ্নটি উঠেছে বলেই এ নিয়ে নাগরিকের বিচলিত হওয়ারও চিন্তা থাকছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Law Supreme Court Democracy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy