E-Paper

স্বার্থ সংঘাত

বাঘ লোকালয়ে ঢুকে মানুষ মেরেছে, এই ঘটনা বিরল। মানুষ জ্বালানি, মাছ, মধু, কাঁকড়ার সন্ধানে জঙ্গলে ঢোকায় প্রাণহানি ঘটে।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:০৮

সুন্দরবন লাগোয়া জনবসতির মানুষগুলির জীবন কতখানি অনিশ্চয়তায় ভরা তা আবারও প্রকাশ্যে এল গত মাসে। শীতের মুখে একই সপ্তাহে সিঁদুরকাটির ও চামটার জঙ্গলে বাঘের আক্রমণে দু’টি অপমৃত্যু এলাকায় শোক ও ত্রাসের সঞ্চার করেছে। দু’ক্ষেত্রেই বাঘ নৌকার উপরে বসে থাকা মানুষকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়েছে। সুন্দরবনের বাঘ নরখাদক— বিশ্ব জুড়ে পুঞ্জীভূত এই জল্পনা এই ঘটনাক্রমে আরও তীব্র হওয়ারই শঙ্কা। কিন্তু, মনে রাখা জরুরি, অন্যান্য জঙ্গলের মতোই এখানকার প্রতিটি বাঘ মানুষখেকো নয়। যদি তা হত তবে প্রতিটি বাঘ বছরে গড়ে ৫০টি মানুষ মারত, সে ক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা কোন অঙ্কে পৌঁছত সহজেই অনুমেয়। অযথা আতঙ্ক না ছড়িয়ে বোঝা দরকার যে, পরিবেশের বিরূপতা ও বিকল্প জীবিকার অভাব বাদাবনের বাঘ-মানুষ সম্পর্ককে এমন ভাবে জটিল ও সঙ্কটাপন্ন করে রেখেছে, যাতে বিপদ দু’পক্ষেরই।

বাঘ লোকালয়ে ঢুকে মানুষ মেরেছে, এই ঘটনা বিরল। মানুষ জ্বালানি, মাছ, মধু, কাঁকড়ার সন্ধানে জঙ্গলে ঢোকায় প্রাণহানি ঘটে। সঙ্গে এও ঠিক, নোনা জল বাঘের শরীর, আচরণে প্রভাব ফেলে। অন্য জঙ্গলের মতো ভারী চেহারার তৃণভোজীও এখানে নেই, আছে হরিণ, বানর, শূকর। কর্দমাক্ত জলজঙ্গল, শ্বাসমূলের কারণে সেগুলিকেও শিকারে সমস্যায় পড়ে বাঘ। ফলে তার সংগ্রামও কম নয়। অন্য দিকে, মানুষ সঙ্কীর্ণ খাল বা খাঁড়িতে ঢুকে যখন ডাল বা মৌচাক কাটে, জাল পাতে, খুঁটি পোঁতে, কাঁকড়ার জন্য পায়ে হেঁটে কাদায় শিক গাঁথে তখন অরক্ষিত ও অসতর্ক থাকার কারণে বন্যপ্রাণের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা প্রবল। তখন মাংসাশী প্রাণী অন্যান্যের চেয়ে শ্লথ ও দুর্বল মানুষকে সহজ শিকার জ্ঞানে আক্রমণ করে। জঙ্গলের ঝুঁকিপূর্ণ জীবিকায় বাঘ-কুমির-কামটের সঙ্গে যুঝতে হবে, জঙ্গলবাসী জনগোষ্ঠী তা অবগত— জঙ্গলজীবনের রীতিনীতি, বনদেবী, বনবিবির বিশ্বাস তারই প্রমাণ। তা সত্ত্বেও মানুষ যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে বাধ্য হন তার কারণ অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা। উপার্জনের তাড়না এতটাই যে অনেক সময়ই বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়াই তাঁরা জঙ্গলে যান, টহলদার নৌকা দেখলে আরও সঙ্কীর্ণ খালে আত্মগোপনের চেষ্টা করেন, যার পরিণাম প্রাণঘাতী।

বাঘসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শান্তিপূর্ণ বাসস্থান ও খাদ্যশৃঙ্খলের স্বাস্থ্যের উন্নতিও বন দফতরের দায়িত্ব। প্রয়োজন কর্মসংস্থান। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে মানুষকে সংসার প্রতিপালন করতে হচ্ছে, এই চিত্রটুকুই রাজ্যের কর্মক্ষেত্রের বনিয়াদি স্তরের দুরবস্থাকেও বেআব্রু করে। অরণ্যসম্পদে ভরসা রাখলে জঙ্গলে ঢোকার বদলে বাক্সে মধুমক্ষিকা প্রতিপালন, নিরাপদ স্থানে ও পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষের প্রচলন বাড়াতে হবে। অন্যান্য জঙ্গলের নকশায় ‘হোমস্টে’ ইত্যাদি চালু করলে পর্যটনশিল্প থেকেও গ্রামবাসীরা লাভবান হবেন। আয়তনে বিরাট এই বনে পর্যাপ্ত টহলদারের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনই গ্রামে গ্রামে সতর্কতামূলক প্রচার করতে হবে, জঙ্গলকিনারার জালকে পোক্ত রাখতে হবে এবং তা সত্ত্বেও মানুষ নিয়ম ভাঙলে, জাল কাটলে, জঙ্গলে অবৈধ প্রবেশ করলে, কঠোর শাস্তি দানের ব্যবস্থা করতে হবে। বাঘ ও মানুষ উভয়ের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকলে তবেই পারস্পরিক সংঘাত কমানো সম্ভব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sundarbans Royal Bengal Tiger

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy