E-Paper

জলমগ্ন

দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বরাবরই প্রশাসনের শীর্ষমহল থেকে ডিভিসি-কে দোষারোপ এবং কেন্দ্রের অবিবেচনার প্রসঙ্গটি তোলা হয়। বাস্তবে এই দাবি অ-সত্যও নয়।

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:৩৩

ভরা বর্ষায় নিম্নচাপের উদয় দক্ষিণবঙ্গকে প্রতি বছরই জলমগ্ন করে। পুজোর মুখে এই অনিশ্চয়তা, বিপুল ক্ষতির চিত্র পশ্চিমবঙ্গের অতি পরিচিত। কিন্তু নিজ রাজ্যে বৃষ্টির চেয়েও পড়শি ঝাড়খণ্ডের অতিরিক্ত বৃষ্টি দক্ষিণবঙ্গে কাঁপন ধরায় বেশি। কারণ, জলাধারগুলিতে জলের চাপ বাড়ে, মাত্রাতিরিক্ত ছাড়া জলে ভেসে যায় দক্ষিণবঙ্গের বিশাল অঞ্চল। সাম্প্রতিক নিম্নচাপের কারণে দক্ষিণবঙ্গ পর্যাপ্ত বৃষ্টি পেয়েছে। কিন্তু বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি হ্রাস পাওয়ার পরের পর্যায়ে, ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হওয়ায় ডিভিসি-র জলাধার থেকে জল ছাড়ায়। যে জল দক্ষিণবঙ্গে ঢুকে কার্যত তছনছ করে দিয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ‘ম্যান মেড বন্যা’ বলে। তাঁর দাবি, এত পরিমাণ জল এর আগে কখনও ছাড়া হয়নি। সুতরাং, পরিকল্পিত ভাবে বাংলায় এই বন্যা করা হচ্ছে।

দক্ষিণবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বরাবরই প্রশাসনের শীর্ষমহল থেকে ডিভিসি-কে দোষারোপ এবং কেন্দ্রের অবিবেচনার প্রসঙ্গটি তোলা হয়। বাস্তবে এই দাবি অ-সত্যও নয়। এক লপ্তে আড়াই-তিন লক্ষ কিউসেক জল ছাড়া হলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছয়, ঘাটাল, পাঁশকুড়া, পুরশুড়া, খানাকুল, আরামবাগ, গোঘাট, তারকেশ্বর, উদয়নারায়ণপুর তার জ্বলন্ত প্রমাণ। একাধিক প্রাণহানিও ঘটেছে ভয়াল বন্যায়। এটাও বাস্তব যে, জলধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে ব্যারাজ। কারণ গত সাত দশকে এক বারও কেন্দ্র সেখানে ড্রেজিং-এর কাজ করেনি। ফলে, নির্ধারিত জলধারণ ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম জল জমলেই জল ছাড়তে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বয়ং জানিয়েছেন, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে ডিভিসি-তে ড্রেজিং সম্ভব নয়। আশ্চর্য লাগে, তবে কি প্রতি বছর বন্যায় মানুষ, ঘরবাড়ি, চাষের জমি-সহ ভেসে যাওয়াই নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে দক্ষিণবঙ্গের? রাজ্যই বা কেন নদীবাঁধগুলিকে বছরের পর বছর অরক্ষিত রেখে দিয়েছে, এ প্রশ্নও জরুরি। এই বছরও একের পর এক নদীবাঁধ ভাঙায় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল-সহ একাধিক জায়গায় প্লাবন হয়েছে। অভিযোগ, বন্যার জন্য কুখ্যাত ঘাটালে নদীবাঁধ মেরামতির নির্দেশ স্বয়ং সেচমন্ত্রীর তরফ থেকে এলেও তাতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যে জায়গাগুলি ভূ-প্রকৃতিগত ভাবেই নিচু, সেখানে বাঁধ মেরামতির কাজ যথাযথ না হলে অতিবৃষ্টিতে পরিণাম কী হতে পারে, রাজ্য প্রশাসন জানে না? বাঁধের উপর বেআইনি নির্মাণ ঠেকাতেই বা কী পদক্ষেপ হয়েছে? বস্তুত, প্রতি বছর বন্যার পর ডিভিসি-কে কেন্দ্র করে কেন্দ্র-রাজ্য দায় ঠেলাঠেলির যে পর্ব চলে, তাতে রাজনীতির রসদ থাকে প্রচুর। কিন্তু প্রকৃত সমাধানসূত্র মেলে না।

সর্বোপরি, কেন বার বার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতি ছাড়া ডিভিসি-র জল ছাড়ার অভিযোগ ওঠে? নিয়ম অনুযায়ী, জল কমিশন, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড এবং ডিভিসি-র প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তা সত্ত্বেও, পশ্চিমবঙ্গের দিক থেকে যথাসময়ে খবর না পাওয়ার অভিযোগ উঠছে কেন, সব পক্ষকেই তার উত্তর খুঁজতে হবে। এই উদ্যোগ ছাড়া রাজ্যের আধিকারিকদের প্রত্যাহার করে নিলে বা ডিভিসি-র সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার কথা বললে প্রকৃত সমাধান মিলবে না। এ-হেন জলযুদ্ধে শেষপর্যন্ত কোনও পক্ষেরই লাভবান হওয়ার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ বিষয়টির মধ্যে ক্ষোভ এবং আবেগ যতটা আছে, সমাধানের প্রচেষ্টা ততটা নেই। বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় পণ্যবাহী ট্রাক আটকানোর মধ্যেও বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় মেলেনি। সীমান্তে ট্রাক আটকালে পশ্চিমবঙ্গের বাজারেই আগুন লাগবে, পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদের বুঝতে যে দেড় দিন লাগল, তা বিস্ময়কর। বন্যা এবং তৎপরবর্তী আর্থসামাজিক বিপর্যয় কঠোর বাস্তব। আবেগসর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছনো যাবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Flood Situation In Bengal Flood Situation DVC Barrage Jharkhand West Bengal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy