একই সঙ্গে যদি বন্ধ হয়ে যায় জল এবং আকাশপথ? ইজ়রায়েল ও ইরানের সংঘাত নিয়ে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার বৃহত্তম চিন্তা এখন এটাই। আরব থেকে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করেছে যে জলরাশি, সেই স্ট্রেট অব হরমুজ়কে বৈশ্বিক পেট্রলিয়াম বাণিজ্যের রাজপথ বললে অত্যুক্তি হয় না। দুনিয়ার মোট পেট্রো-বাণিজ্যের ৩৩ শতাংশ এই পথ ধরে যায়। ইরান ইতিমধ্যেই একাধিক বার হুমকি দিয়েছে যে, ইজ়রায়েল আক্রমণের তীব্রতা বাড়ালে তারা এই পথ বন্ধ করে দেবে। ইতিহাস অবশ্য কিঞ্চিৎ ভরসা দিচ্ছে। ১৯৮০-র দশকের দীর্ঘমেয়াদি ইরান-ইরাক সংঘাতের সময় দু’পক্ষই এই প্রণালী দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য-জাহাজকে সামরিক লক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করলেও সে সময় প্রণালীটি সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়নি। পেট্রলিয়াম বাণিজ্যের পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ইরান যদি প্রণালী বন্ধ করে, তা হলে তাদের পেট্রো-বাণিজ্যও বন্ধ হবে। তার প্রভাব পড়বে সে দেশের রাজস্বের উপরে। যুদ্ধের বাজারে এত বড় ঝুঁকি তারা নেবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় আছে। তবে, ইজ়রায়েল ইরানের উপরে যে হামলা করেছে, তা-ও কার্যত অ-পূর্ব। ফলে, ইরানের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। তেলের বাজারে স্বভাবতই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, এবং এক সপ্তাহের মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। যুদ্ধ চলতে থাকলে, প্রণালী যদি বন্ধ না-ও হয়, বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটা প্রায় নিশ্চিত। ফলে, তেলের দামও ঊর্ধ্বগামী হবেই। এবং, তার প্রভাব পড়বে দুনিয়ার সব দেশেই, বিশেষত যারা পেট্রলিয়াম আমদানির উপরে নির্ভরশীল।
অন্য দিকে, যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর থেকেই পশ্চিম এশিয়ার আকাশ বিপদসঙ্কুল, ফলে বহু আন্তর্জাতিক বিমান বন্ধ হয়েছে; পথ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে আরও অনেক বিমান। যাত্রাপথ দীর্ঘ হলে তা শুধু যাত্রার সময় বা ব্যয় বাড়ায় না, তৈরি করে আরও একটি অসুবিধা— অনেক বেশি জ্বালানি বহনের বাধ্যবাধকতা। বহু বিমানেরই বহনসীমার চেয়ে তা বেশি। ফলে বৈশ্বিক অসামরিক বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে এই যুদ্ধের তুমুল নেতিবাচক প্রভাব পড়তে আরম্ভ করেছে। আজকের বৈদ্যুতিন যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগেও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যাতায়াতের গুরুত্ব ফুরোয়নি। ফলে, বিমান পরিষেবা ব্যাহত হওয়ায় তা প্রভাবিত করছে আন্তর্জাতিক পুঁজিকে। এ ক্ষেত্রে ভূগোল আরও একটি ভূমিকা পালন করছে। গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণের যে ‘হাব’গুলি গড়ে উঠেছে, তার অন্যতম কেন্দ্র হল আরব দেশগুলি। পশ্চিম এশিয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠলে বিপন্ন হচ্ছে এই হাবগুলিও, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে বৈশ্বিক বিমান পরিবহণ ব্যবস্থার উপরে।
এই যুদ্ধের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছবে, এখনই তা নিশ্চিত ভাবে অনুমান করা অসম্ভব। তবে, যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব যে ক্ষেত্রগুলির উপরে পড়ছে, সেগুলি প্রভাবিত করবে আরও অনেক কিছুকে; আবার তার প্রভাব পড়বে অন্যতর ক্ষেত্রে। যেমন, পেট্রলিয়ামের দাম বাড়লে তা সামগ্রিক ভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটায়, কারণ সব দেশেই শিল্পক্ষেত্র তো বটেই, কৃষি বিপণনও পরিবহণ-নির্ভর। তেলের দাম বাড়লে সব জিনিসেরই দাম বাড়ে। আবার, মূল্যস্ফীতি ঘটলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক তার মোকাবিলা করতে বাধ্য। ফলে, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি যে শিথিল মুদ্রানীতির পথে হাঁটতে আরম্ভ করেছে, মূল্যস্ফীতি ঘটলে তা স্থগিত রেখে ফের সুদের হার বাড়াতে হবে। তার প্রভাব পড়বে অর্থব্যবস্থায় বিনিয়োগের মাত্রায়। তা প্রভাবিত করবে কর্মসংস্থানের হারকে। আবার, আন্তর্জাতিক পুঁজি যদি যুদ্ধের ভয়ে নিরাপদতর সম্পদের সন্ধান করে, তা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ। যে দেশগুলি ভৌগোলিক ভাবে এই যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে, বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার জাল সেগুলিকেও এ ভাবেই জড়িয়ে নিচ্ছে যুদ্ধের সঙ্গে। এটি বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থার ধ্রুব সত্য— পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের অস্বাভাবিকতাই শেষ অবধি বৈশ্বিক বিপদ।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)