একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ট্যাবের টাকা কী ভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণির দুষ্কৃতী, তার ছবি এত দিনে স্পষ্ট। সমস্যার মূল অসুরক্ষিত ডিজিটাল ব্যবস্থায়। প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে ইন্টারনেট সংযোগ খারাপ। ‘বাংলা পোর্টাল’ ওয়েবসাইট, যেটিতে প্রবেশ করে ছাত্রছাত্রীদের নাম, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি নথিভুক্ত করতে হয়, তাতে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য হচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকায়। দিনে-রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য সেটির নাগাল মিলছে, অভিযোগ উঠছে নানা জেলা থেকে। এমন নানা কারণে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বাধ্য হচ্ছেন স্থানীয় সাইবার কাফেগুলির উপর নির্ভর করতে। এর ফলে এই সব কাফের মালিক ও কর্মী, যাদের কোনও ভাবেই ছাত্রছাত্রীদের অ্যাকাউন্ট-সংক্রান্ত তথ্যের নাগাল পাওয়ার কথা নয়, তারা সে সব তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। কিছু অসতর্কতা রয়েছে স্কুলের তরফেও। তথ্য আপলোড করার পর শিক্ষা দফতর প্রদত্ত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে দেওয়ার কথা স্কুল কর্তৃপক্ষের। অনেক শিক্ষক সে কাজ করে উঠতে পারেননি। তাই সাইবার কাফের মাধ্যমে পোর্টালে ঢুকে অ্যাকাউন্ট নম্বর পরিবর্তন করে, অন্য অ্যাকাউন্টে ট্যাবের টাকা সরিয়ে নেওয়া দুষ্কৃতীদের পক্ষে কঠিন হয়নি। টাকা নয়ছয়ে জড়িত সন্দেহে নানা জেলা থেকে কয়েক জন শিক্ষককেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
মনে রাখতে হবে, ট্যাবের টাকা চুরিই একমাত্র ক্ষতি নয়। এতগুলি ছাত্রছাত্রীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-সহ নানা তথ্যও যে ফাঁস হয়ে গেল, এটাও অত্যন্ত উদ্বেগের কথা। সরকারি প্রকল্পই যদি ডিজিটাল তথ্য সুরক্ষিত না রাখতে পারে, তা হলে কার উপরে ভরসা করবে নাগরিক? আক্ষেপের কথা, একটি নবীন প্রজন্মের ডিজিটাল লেনদেনের অভিজ্ঞতার সূচনাই হল এক জঘন্য জালিয়াতির ঘটনা দিয়ে। সাইবার কাফের কর্মী, দুর্নীতিতে জড়িত শিক্ষক, সুরক্ষায় বিচ্যুতির জন্য অভিযুক্ত স্কুল কর্তৃপক্ষ, এঁদের দোষারোপ করা হচ্ছে। হয়তো কারও কারও শাস্তিও হবে। কিন্তু দোষ কি কেবল শিক্ষকদের? স্কুলগুলিকে কেন্দ্র করে প্রায় ত্রিশটি সরকারি প্রকল্প চলছে। নিয়মিত কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর তথ্য আপলোড করতে হয় বিভিন্ন পোর্টালে। তার জন্য যথেষ্ট সময় ও দক্ষতা দরকার। তার ব্যবস্থা হয়েছে কতটুকু? শিক্ষকদের কেন নিজেদের সময় ব্যয় করে, এমনকি ক্লাস না করে, ছাত্রছাত্রীদের তথ্য আপলোড করতে হবে? এ বছর একই সঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ট্যাবের অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাই কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। যেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিলিবণ্টন হচ্ছে স্কুলগুলির মাধ্যমে, সেখানে স্কুলগুলিতে প্রকল্প চালানোর উপযোগী পরিকাঠামো ও কর্মী নেই কেন? স্কুলে এক জন ‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর’ নিয়োগ করা হচ্ছে না, এটা বড়ই আশ্চর্যের কথা। প্রান্তিক এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুলের জন্য এক জন কর্মী নিয়োগ করা যেতে পারে, যিনি স্কুলে স্কুলে গিয়ে সে কাজ করবেন। অথবা, সরকার-নির্দিষ্ট সাইবার কাফের সঙ্গে স্কুলের সংযোগ করা যেতে পারে। অথবা বিডিও দফতরে স্কুলের প্রকল্পগুলি সম্পর্কিত তথ্য আপলোড করার কাজটি করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষকদের একাধিক সংগঠন নানা প্রস্তাব রেখেছে। সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। দুর্বল পরিকাঠামো, ঢিলেঢালা ব্যবস্থার সুযোগ যে চোর-জালিয়াতরা সানন্দে গ্রহণ করবে, তাতে আশ্চর্য কী? এতে কেবল অর্থের অপচয় হয় না, প্রকল্পের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হয়। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ‘ডিজিটাল দূরত্ব’ ঘোচাতে ট্যাব বিলি করছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ অনিয়মিত হলে ছাত্রছাত্রীরা অনলাইন ক্লাস করতে, পাঠ্য ডাউনলোড করতে কতটা সফল হবে? তাদের হাতের যন্ত্রগুলি সরকারের সদিচ্ছার প্রতীক হয়েই রয়ে যাবে, সক্ষমতার অস্ত্র হয়ে উঠবে না। সরকারকে বুঝতে হবে, আর্থ-সামাজিক ন্যায় চাইলে অনুদানই যথেষ্ট নয়, দরকার পরিকাঠামো উন্নয়ন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)