Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2024

লাঠি ও গাজর

লালবাজার অভিযানে জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে-ধরা মেরুদণ্ডের প্রতিকৃতি ইতিমধ্যেই পুজোর অঘোষিত ‘থিম’ হয়ে উঠেছে। তাই নিজেদের টাকায় অনাড়ম্বর পুজো এ বার গর্বের বিষয়। জনস্রোতে নানা মত মিলে নির্ধারিত হয়েছে মনোরথের এই নতুন ঠিকানা।

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৭:০৬
Share: Save:

সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করলে মিলবে না বিদ্যুতে ছাড়, বা দমকল পরিষেবায় ভর্তুকি, এমনই একটা কথা পুলিশের তরফে জানানো হচ্ছে বিভিন্ন পুজো উদ্যোক্তাদের। কোনও লিখিত নির্দেশ নেই— ভাষার খেলায় এমন জুলুমকে ‘সরকারি নিয়ম’ করে দেখাতে পারেন, এমন আধিকারিক সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ সরকারেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাংবাদিকের কাছে এক পুলিশকর্তা বলেছেন, পুজোর অনুদান হল একটা ‘প্যাকেজ’। অনুদান নিলে তবেই বিদ্যুতের বিলে ছাড়, দমকল পরিষেবায় ভর্তুকি মিলবে। এ কথা সত্যি কি না— অর্থাৎ অনুদান না নিলে সত্যিই অন্যান্য পরিষেবার জন্য বেশি টাকা গুনতে হবে কি না— কেউ জানে না। কিন্তু হতে পারে, সেই সম্ভাবনা খাঁড়ার মতো ঝুলিয়ে রাখা হল। এই হল সেই ভীতিপ্রদর্শনের অভ্যাস বা ‘থ্রেট কালচার’ যা নাগরিক সমাজ চিহ্নিত করেছে এবং বর্জন করতে চেয়েছে। সেই বর্জনের একটা দিক হয়ে উঠেছে পুজোয় সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান। সংযোগটা স্পষ্ট— শাসক দল আনুগত্য আদায়ের উপায় হিসাবে ব্যবহার করে পুলিশের লাঠি, আর সরকারি অনুদানের গাজর। লাঠি প্রত্যাখ্যান করলে গাজরও প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ক্লাবের পুজোর জন্য সরকারি অনুদানকে বলা চলে এক ‘অতি-গাজর’— করের টাকার যুক্তিহীন অপব্যয়— তাই তা বর্জনের দাবি উঠেছে সবচেয়ে বেশি। ক্লাবগুলি কেবল বিবেক-দংশনে অনুদান প্রত্যাখ্যান করছে তা নয়, নিজেদের স্বচ্ছ, উন্নত-শির ভাবমূর্তি বজায় রাখতে হবে পুজোর কর্তাদের, সেই তাগিদও কিছু কম নয়। লালবাজার অভিযানে জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে-ধরা মেরুদণ্ডের প্রতিকৃতি ইতিমধ্যেই পুজোর অঘোষিত ‘থিম’ হয়ে উঠেছে। তাই নিজেদের টাকায় অনাড়ম্বর পুজো এ বার গর্বের বিষয়। জনস্রোতে নানা মত মিলে নির্ধারিত হয়েছে মনোরথের এই নতুন ঠিকানা।

জনমতের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসামান্য সংবেদনশীলতা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক বৈশিষ্ট্য। কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শের অনুসরণ করেননি তিনি, বরং জনগণের কথিত-অকথিত চাহিদা পূরণ করে নিজেকে অবিসংবাদিত নেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ, আর জি কর-কাণ্ডের পর নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আবেগ সর্বস্তরে কাজ করছে, তার স্পন্দন যেন তিনি স্পর্শ করতে পারছেন না। তাঁর কথায়, কাজে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। তাঁর পুলিশ কখনও দেখাচ্ছে জরিমানার ভয়— সরকারি অনুদান নিতে রাজি না হলে পুজোয় বিদ্যুতে ভর্তুকি বন্ধ হবে, দমকলকে আরও টাকা দিতে হবে। কখনও বা সরাসরি জেল— যাঁরা আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ করছেন, সেই সব ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীকে নানা মামলা দিচ্ছে পুলিশ, গ্রেফতারও করেছে। সংবাদে প্রকাশ, প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হেনস্থা হয়েছেন, কর্মীরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে শাসক দলের কর্মী সংগঠন চাপ সৃষ্টি করছে, কখনও কর্মকর্তারা। অর্থাৎ নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ স্বচ্ছ, ভয়মুক্ত সমাজের যে দাবি করছেন, তার উত্তরে ভয় দেখানোর সংস্কৃতিকেই সম্বল করছেন শাসক।

এতে তৃণমূলের সমর্থক নাগরিকরাও বিপাকে পড়ছেন। দলের প্রতি সমর্থন চাইতে গেলে যেমন-তেমন একটা যুক্তি খাড়া করা চাই। যে প্রতিষ্ঠান সরকারি অনুদান নেবে না, তাকে বস্তুত সরকারের পুরস্কৃত করা উচিত, কারণ তা রাজকোষের অর্থ বাঁচাচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে তার বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি খারিজ করা যায়? দমকলের মতো অত্যাবশ্যক পরিষেবা কেন তার জন্য আরও সুলভ না হয়ে আরও দুর্মূল্য হবে? সরকারি ‘প্যাকেজ’ শাসকের আনুগত্য ক্রয়ের চেষ্টাকে কতখানি নগ্ন করেছে, তার প্রমাণ ভাতারের তৃণমূল বিধায়ক মানগোবিন্দ অধিকারী। তিনি অনুদানের চেক বিলি করার অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন, টাকা নিলে মণ্ডপে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি টাঙাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীকে দর্শন না করে দেবীদর্শনও করা চলবে না, লাঠি বটে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE