E-Paper

ফাঁদ

শিল্পের স্বাধীনতার বুড়িটি ছুঁয়ে থেকেও কয়েকটি জরুরি কথা বলা দরকার। বেঙ্গল ফাইলস ছবিটির বিষয় ১৯৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’, বাংলা ও ভারতের ইতিহাসে যা এক অতি স্পর্শকাতর অধ্যায়। ছবির বিষয়ের জন্য তাকে কাঠগড়ায় তোলা যায় না, এ ক্ষেত্রেও তা হয়নি।

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৫ ০৪:০৮

বইয়ের মতোই, সিনেমাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণার বা বর্জনের ডাক এসেছে যুগে যুগে। তার গায়ে গায়েই এসেছে শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রসঙ্গ: কোনও সিনেমা অপ্রিয় কথা বলছে বলেই তাকে বয়কট করা যায় কি না, বা মুক্তি পাওয়ার পর প্রেক্ষাগৃহে তার প্রদর্শনে বাধা দেওয়া যায় কি না সেই প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরটি নিঃসন্দেহে ‘না’— কোনও সিনেমা বা অন্য যে কোনও শিল্পবস্তু যতই কারও রুচি, মূল্যবোধ, ভাবনায় আঘাত করুক, তাকে নিষিদ্ধ করা বা তার প্রদর্শনে বাধা দেওয়া চলে না। এমনকি সেই ছবির নাম দ্য বেঙ্গল ফাইলস হলেও। ছবির ট্রেলার মুক্তি পাওয়ামাত্র বঙ্গসমাজে প্রবল আলোড়ন উঠেছে, যে বাঙালি অভিনেতারা তাতে অভিনয় করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে চলছে বিষোদ্গার। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে ভেবে দেখা দরকার, দিনশেষে যা শুধুই এক পর্দার অভিনয়, তার জেরে ওই বিদ্বেষবিষ তাঁদের প্রাপ্য ছিল কি না।

শিল্পের স্বাধীনতার বুড়িটি ছুঁয়ে থেকেও কয়েকটি জরুরি কথা বলা দরকার। বেঙ্গল ফাইলস ছবিটির বিষয় ১৯৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’, বাংলা ও ভারতের ইতিহাসে যা এক অতি স্পর্শকাতর অধ্যায়। ছবির বিষয়ের জন্য তাকে কাঠগড়ায় তোলা যায় না, এ ক্ষেত্রেও তা হয়নি। কেন সবাই স্রেফ ট্রেলার দেখেই ছবির বিরুদ্ধে খেপে উঠলেন তার কারণ ছবির দৃষ্টিভঙ্গি— সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, রক্ত, হত্যা দিয়ে মোড়া এক যন্ত্রণাময় ইতিহাস ফিরে দেখতে গিয়ে এখানে দর্শককে বলে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারা এর জন্য দায়ী, কোন ধর্মসম্প্রদায়; এবং ’৪৬-এর ১৬ অগস্ট-পরবর্তী সংখ্যাগুরুর প্রত্যাঘাতকে দেখানো হচ্ছে ‘উচিত কাজ’ বলে। আজকের ভারতে প্রবল হিন্দুত্ববাদী আবহে একটি ছবির এই ‘দর্শন’ নানা কারণে বিপজ্জনক— সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে তা ‘ঐতিহাসিক ঘৃণা’ জাগিয়ে তুলতে পারে; এই মুহূর্তের বাঙালি নিপীড়নের প্রেক্ষিতে মাথাচাড়া দেওয়া ‘বাঙালি অস্মিতা’ এই ছবি দেখে ভাবতে পারে যে মার খাওয়া অনেক হয়েছে, চাই সে-দিনের মতো প্রত্যাঘাত, ‘অসাম্প্রদায়িক বাঙালি’ থেকে সে হয়ে উঠতেই পারে স্রেফ ‘হিন্দু বাঙালি’। এটিই যে ছবিটির অভিপ্রায়, সে যুক্তিটি ফেলে দেওয়ার নয়— দ্য কাশ্মীর ফাইলস ছবিতেও একই ছক ব্যবহৃত। একটি সিনেমা যখন সমাজকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিষিয়ে তোলে, তখন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ দুর্ভাগ্যজনক হলেও অসম্ভব নয়, আগেও হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও কি তা হবে?

সিনেমাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে সমাজ খেপিয়ে তোলা যতটা আতঙ্কের, সিনেমায় দেখানো যা কিছুকেই ‘প্রকৃত ইতিহাস’ বলে প্রচার ততটাই ভয়ঙ্কর। আজকের ভারতে অনেক ছবিই সেই দোষে দুষ্ট, বেঙ্গল ফাইলস-এর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। ‘ইতিহাস’ স্রেফ অতীত ঘটনাবলির যদৃচ্ছ সঙ্কলন নয়, তাতে তথ্য ও সত্যের পক্ষপাত-বিযুক্ত বিশ্লেষণ থাকে, সেই বিশ্লেষণেরও একটা পদ্ধতি আছে যা অধ্যবসায় যোগে শিখতে হয়। চলচ্চিত্র-দর্শকের বোঝা দরকার, সিনেমা দেখে ইতিহাস শেখার মধ্যে একটা মস্ত ফাঁকি আছে; কারণ পর্দায় যা দেখানো হচ্ছে তা হয় কল্পনায় রঞ্জিত বা বিশেষ উদ্দেশ্যে অতিরঞ্জিত। বেঙ্গল ফাইলস-এর ক্ষেত্রে সেই ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’টি কী, তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না— গায়ের জোরে খণ্ডসত্যকে পূর্ণ করে দেখানোর অভিসন্ধি। বাঙালি দর্শক-সমাজ যেন এই ফাঁদে পা না দেয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

The Bengal Files Film Controversy Vivek Agnihotri

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy