পুড়ছে ইউরোপ। তাপপ্রবাহে, দাবানলেও। আপাতত পশ্চিম ইউরোপকে দগ্ধ করে তাপপ্রবাহ পূর্ব দিকে ধাবমান, পশ্চিমের তাপমাত্রাও খানিক নিম্নগামী। তবেস্বস্তি দূর অস্ত্। পরিসংখ্যান বলছে, ক্রমশ বাড়তে থাকা গরম এবং প্রতি বছর সে ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি-ই ইউরোপে ‘নিউ নর্মাল’। এই বছরের জুন মাসটি যেমন স্পেন এবং ইংল্যান্ডে উষ্ণতম বলে চিহ্নিত হয়েছে। উইম্বলডন টুর্নামেন্ট শুরুর দিনে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৩২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, উইম্বলডনের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড। এ বছরই পর্তুগালে এক দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের রেকর্ড গড়েছে। রেহাই পায়নি ফ্রান্সও। লাল সঙ্কেত জারি হয়েছে প্যারিস-সহ ১৫টি অঞ্চলে। ইটালিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাসিন্দাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে, দুপুরবেলার কয়েক ঘণ্টা, তাপমাত্রা যখন চরমে উঠছে, বাইরের কাজ বন্ধ রাখতে। বাড়ছে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ও। সুতরাং, মৃত্যু, গরমজনিত অসুস্থতা বৃদ্ধি, দৈনন্দিন কাজকর্ম প্রবল ভাবে ব্যাহত হওয়া, তুরস্ক, গ্রিস, পর্তুগাল, ইটালির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দাবানলের তীব্রতা বৃদ্ধি— বিপদ ঘনাচ্ছে ইউরোপের জনজীবনে।
এই বেলাগাম তাপপ্রবাহ অপ্রত্যাশিত নয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, এমন চরম উষ্ণ আবহাওয়া আগামী দিনে আরও বেশি করে, এবং আরও তীব্র ভাবে অনুভব করবে বিশ্ববাসী। কারণ, বিশেষজ্ঞদের অনুমান অভ্রান্ত প্রমাণ করে পৃথিবী উষ্ণতর হয়ে উঠছে। ইউরোপের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের আঘাতটি সর্বাধিক। পরিসংখ্যান বলছে, মহাদেশগুলির মধ্যে ইউরোপই সবচেয়ে দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে। বিশ্বে যেখানে প্রতি দশকে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.২ ডিগ্র সেলসিয়াস, সেখানে ইউরোপে এই হার ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর বিশ্বের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব-পূর্ব যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে গত পাঁচ বছরে তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লব-পূর্ব যুগের তুলনায় গড়ে প্রায় ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস অধিক থেকে গিয়েছে। নতুন গবেষণা বলছে, ইউরোপের গ্রীষ্ম ঋতুটি আর চিরচেনা সময়সীমাতে আবদ্ধ থাকবে না। তা আরও দীর্ঘতর হয়ে উঠবে। কিছু শহরে তা বছরে পাঁচ মাস অবধিও টিকে যাবে।
অধিক তাপমাত্রা শুধুমাত্র শারীরিক এবং পরিবেশগত ক্ষতি ডেকে আনে না, অর্থনীতিতেও মোক্ষম ধাক্কা দেয়। সে ক্ষতির মোকাবিলা বিষয়ে এখনই ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু সমস্যা সেখানেই। জলবায়ুর মতো বৈশ্বিক বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপগুলি শুধুমাত্র নিজের দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখলেই চলবে না, ভাবতে হবে ‘অন্য’দের বিষয়েও। কিন্তু ধনী দেশগুলি সে পথে হাঁটতে নারাজ। সম্প্রতি ব্রিকস সম্মেলনে যৌথ বিবৃতিতে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ জোর গলায় বলেছেন, জলবায়ু খাতে অর্থ বরাদ্দ করা ধনী দেশগুলির উন্নয়নশীল দেশের প্রতি কর্তব্য। অথচ, সে কর্তব্য যথাযথ পালিত হচ্ছে না। আগামী নভেম্বর ব্রাজ়িলে হতে চলা আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন সিওপি ৩০-এর চিফ এগজ়িকিউটিভ আনা টোনি মূল্যবান একটি মন্তব্য করেছেন— “জলবায়ুই আমাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।” আরও বলেছেন, সামরিক আর বাণিজ্য যুদ্ধগুলি অত্যন্ত ক্ষতিকর— সেগুলি জলবায়ু থেকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয় অন্য দিকে। উন্নত বিশ্ব আদৌ সে বিষয়ে সচেতন কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)