শীতকাল কবে কাটবে, মন্ত্রিবর? সম্প্রতি যখন শোনা গেল ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কানাডার নবনির্বাচিত বিদেশমন্ত্রী অনিতা আনন্দ-এর সঙ্গে দীর্ঘ ফোনালাপের কথা, আশা জাগল কূটনৈতিক মহলে— এ বার হয়তো স্বাভাবিক হতে চলেছে ভারত-কানাডার সম্পর্ক। গত মার্চে মার্ক কার্নি কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে এই ফোনালাপটি ছিল দিল্লি ও অটাওয়া-র মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক পর্যায়ের যোগাযোগ। আলোচনায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উপরেও আলোকপাত করা হয়, যা এত কাল স্তিমিত ছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দোষারোপের জেরে। বস্তুত, ২০২৩ সালে দিল্লি এবং অটাওয়া-র মধ্যে তিক্ততা চরমে ওঠে, যখন খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিশিষ্ট সদস্য হরদীপ সিংহ নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে ভারতের সম্ভাব্য যোগ থাকার অভিযোগ তোলে তৎকালীন ট্রুডো সরকার। এই কূটনৈতিক উত্তেজনার পরিণতি ছিল সুদূরপ্রসারী— পরবর্তী কালে উভয় তরফেই শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রদূতদের বহিষ্কার করা হয়, কম্প্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ)-সহ বিবিধ বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত থাকে, প্রভাব পড়ে ভিসা পরিষেবাতেও।
তবে, মার্ক কার্নি দেশের রাশ হাতে নেওয়ার পরে, আপাতদৃষ্টিতে সে দেশের প্রশাসনের তরফে ভারতের সঙ্গে সমন্বয়সাধনের চেষ্টা হচ্ছে। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিবিধ বক্তব্যে নিজ্জরের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে বরং পারস্পরিক সৌহার্দের উপরেই জোর দিয়েছেন, কৌশলগত স্তরে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বলেছেন। ‘সমভাবাপন্ন’ দেশগুলির সঙ্গে কানাডার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৈচিত্রময় করার প্রয়োজনীতার কথা তুলে ধরে, ভারতকে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যশুল্ক সূত্রে টানাপড়েনের পটভূমিতে তাঁর বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন অনেকে। অনিতা আনন্দের বিদেশমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচন ভারত-কানাডার সম্পর্কে আস্থা পুনরুদ্ধারে এক জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। লক্ষণীয়, অনিতার পূর্বসূরি মেলানি জোলি যেখানে নিজ্জর হত্যায় ভারতের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন, সেখানে অনিতা ভারতীয় কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্যের নিন্দা করেছেন।
তবে জয়শঙ্করের সঙ্গে বার্তালাপে অনিতা ধাপে ধাপে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের উপরে জোর দিলেও, নিজ্জর হত্যা সংক্রান্ত তদন্তে আপস করা হবে না বলে জানিয়েছেন। ফলে ইঙ্গিত স্পষ্ট— হত্যাকাণ্ডে ভারতের কথিত ভূমিকার বিরুদ্ধে পূর্বে লিবারাল পার্টি যে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল, আগামী দিনে তা থেকে দূরত্ব বৃদ্ধি সহজ হবে না তাঁর দলের পক্ষে। শুধু তা-ই নয়, সাম্প্রতিক কালে কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে ভারতের বিরুদ্ধে। কানাডায় আসন্ন জি৭ সম্মেলনেও অদ্যাবধি আমন্ত্রণ পাঠানো হয়নি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে— তবে কি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শৈত্য কমল না? পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পরে এমনিতেই ভূরাজনীতিতে কিছুটা নড়বড়ে অবস্থানে ভারত। সুতরাং দিল্লির পক্ষে অটাওয়া-র সঙ্গে নিজের ‘কূটকৌশল’ পুনর্বিবেচনায় মন দেওয়াই ভাল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)