গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সঙ্কট ঘনায় যখন গণতন্ত্রের নাম ধরে স্বেচ্ছাতন্ত্র চালু হয়। এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন কমিশন যে ভাবে ভোটার তালিকা নিবিড় সংশোধনের কাজ করছে, তা এমন এক সঙ্কটের সামনে নাগরিককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিহারের পর, পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যে এই মহাপ্রকল্প সূচনা হতে চলেছে অচিরে। তার প্রস্তুতিপর্বে জাতীয় কমিশনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বাদানুবাদের তীব্রতা যেন সাক্ষাৎ এক যুদ্ধের প্রস্তুতি। কিসের জন্য এই যুদ্ধ? প্রশ্নটি আমূল রাজনীতি-নিমজ্জিত। এক দলের মত, অবৈধ ভোটারকে তালিকায় রাখতে তৃণমূলের ব্যগ্রতাই সব সঙ্কটের কারণ। অন্য দলের বক্তব্য, অন্যায় ভাবে নাগরিককে নিষ্পেষণ করার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শাসকের এই প্রকল্পের পিছনে বিজেপি রাজনীতির শীতল হিসাবটি স্পষ্ট। এ-হেন রাজনীতির জটিল ঘোরপ্যাঁচ থেকে নিজেকে বার করে যদি কেউ সুস্থ মস্তিষ্কে বিষয়টি তলিয়ে দেখেন, তিনি বুঝবেন যে অবৈধ ভোটার বা অনুপ্রবেশকারী ভোটারের নাম বাদ দেওয়া যে কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশের দস্তুর, এতে কোনও নতুনত্ব নেই, থাকার কথা নয়, কোনও দল বা রাজনীতিই প্রকাশ্যে অবৈধ ভোটারদের সমর্থন করতে পারে না। এই দেশে প্রথম বার ভোটার তালিকা সংশোধন হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় বিজেপির হাবভাবটি এমন যে, তারাই প্রথম ‘জঞ্জাল-সাফাই’ করছে, তবে ঘটনা হল স্বাধীন ভারতে যখনই কোনও ভোটার তালিকা নবীকরণ হয়েছে, তাতে মৃত ও অবৈধদের বাদ দেওয়ার দস্তুরই ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার তা সংঘটিত করেছে, এবং রাজ্য সরকারগুলি সে কাজে সহায়তা করেছে। এমনকি কেন্দ্রে ও রাজ্যে আলাদা দলের সরকার থাকলেও সঙ্কট হয়নি, পশ্চিমবঙ্গেও।
তবে এ বারের এই বিচিত্র ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির কারণ কী? এক দিকে মুখ্যমন্ত্রী যুদ্ধং দেহি মূর্তিতে অবতীর্ণ, অন্য দিকে নির্বাচন কমিশন একের পর এক কড়া বার্তা পাঠিয়ে চলেছে রাজ্য সরকার সমীপে। এই সবের কারণ একটিই: অবৈধ ভোটার, অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি শব্দের মোড়কে আসলে নিহিত লক্ষ্যটি নাগরিকত্ব হরণের প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে আছে সংখ্যালঘু সমাজ। এ আর কোনও অনুমান নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও তাঁর সহকর্মী অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা একাধিক মন্তব্যে এ কথা বলেছেন। এখানেই ভোটার তালিকা সংশোধনের আপাত-রীতিমাফিক প্রক্রিয়া এখন কার্যত নাগরিকত্ব যাচাইয়ের অনুশীলনে পরিণত, যে কাজের অধিকার নির্বাচন কমিশনের থাকার কথা নয়। ফলত এসআইআর নিয়ে এই ‘যুদ্ধ’কে আর কেবল দলীয় দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখা যাবে না। সংঘাত-ভূমিটি তদপেক্ষা বড় ও বিপজ্জনক।
আপাতত প্রশ্নটি ঘনীভূত হয়েছে রাজ্য সরকার বনাম নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ার নিয়ে। আধিকারিক নিয়োগ নিয়ে কমিশন কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকারকে, উল্টো দিকে, মুখ্যমন্ত্রী একের পর এক বার্তা দিয়েছেন যে বিএলও-র উপর জবরদস্তি চলবে না। জবরদস্তির কথা উঠছে কেন? উঠছে বিহার পর্বের অভিজ্ঞতা থেকেই। যে ভাবে সে রাজ্যে নাম বাদ পড়েছে, বিশেষত মহিলা ভোটারদের নাম, যাঁদের ঠিকঠাক কাগজপত্র না থাকার সমূহ সম্ভাবনা, তার পর থেকেই প্রক্রিয়াটি প্রশ্নযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্দেহ নেই, এক বার প্রক্রিয়া শুরু হলে বিএলও ও অন্য আধিকারিকরা ভোট-সংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রে কমিশনেরই অধীন। তবে ভোটার তালিকা তৈরির সময় জবরদস্তি করার কোনও নৈতিক অধিকার কারও নেই। এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সমালোচনা, প্রশ্ন বা অভিযোগ কমিশনকে শুনতে হবে। ভোটার তলিকার সংশোধন আগেও হয়েছে, পরেও হবে— এ বারও তা কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী যেন অযথা প্ররোচনামূলক বক্তব্যে বিপদ আরও বাড়িয়ে না তোলেন, এবং নির্বাচন কমিশন যেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কোনও জনগোষ্ঠীকে তালিকাচ্যুত করার ‘লক্ষ্য’ না নেয়, এটাই আপাতত কাম্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)