তথ্য সংক্রান্ত দায়িত্ব সামলানোর প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার বিষয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করা গত এক দশক ধরেই বেশ কঠিন কাজ। আধার থেকে শুরু করে কোভিড অতিমারি— প্রতিটি বিষয়েই তথ্য সংগ্রহ ও তার নথিভুক্তিকরণ হয়ে উঠেছে বিশেষ বিতর্কিত বিষয়, সচেতন নাগরিকমাত্রেই তা অবহিত। তবে সর্বাপেক্ষা বেশি গোলযোগ দেখা গিয়েছে নাগরিকত্ব যাচাই-এর প্রশ্নে— অসম রাজ্যের অভিজ্ঞতাই তার মোক্ষম প্রমাণ। বহু ক্ষেত্রে তথ্য যথাযথ ভাবে সংগৃহীত হয়নি, বহু ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। দশকব্যাপী এ-হেন তথ্য-অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হয় যে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের যে প্রক্রিয়া বিহার রাজ্য থেকে শুরু হল, এখনও অবধি তা নিয়ে নাগরিকের আস্থা অর্জনের ভিতটি অতি মাত্রায় দুর্বল। কমিশনের নির্দেশক্রমে বিহারের ভোটার তালিকায় নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপে ইতিমধ্যেই প্রায় ছত্রিশ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ পড়ার সংবাদে তাই আশ্বস্ত হওয়ার আদৌ কোনও কারণ আছে কি না— এটিই এখন লক্ষকোটি অর্থমূল্যের প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক বহু ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়নি, ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক মহল থেকে সমালোচনা ও বিরোধিতার পরিসরটি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সক্রিয়। বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে এই কাজ করছে। তদুপরি, এক-এক বার এক-এক রকম তথ্য নথিভুক্ত করানোর নির্দেশ দিয়ে কমিশন ভোটারদের বিভ্রান্ত করছে। বিহারের বিধানসভা ভোটের আগে এত তাড়াহুড়ো করে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ করার পিছনেও কোনও রাজনৈতিক প্রণোদনা থাকা স্বাভাবিক, নতুবা সাধারণ মানুষের উপর ফর্ম পূরণের এই ভয়ানক চাপ ও সময়সীমা চাপিয়ে দেওয়ার হেতু কী। নতুন ভোটার তালিকা প্রকাশিত হতে শুরু করার পর বিরোধীদের আরও একটি গুরুতর আপত্তি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে— সাধারণ মানুষের জমা দেওয়া তথ্য ঠিক ভাবে পোর্টালে আপলোড করা বা তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ব্যাপক বিকৃতি। বহু ক্ষেত্রে বিএলও বা বুথ স্তরের আধিকারিকরা বাড়ি বাড়ি তথ্য সংগ্রহ করার সময়ে যে ফর্ম জমা পড়েছে, তাতে নিজের নাম, জন্মতারিখ, ভোটার পরিচয়পত্র, পিতামাতার নাম ও নম্বর সবই লেখা হলেও দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের পোর্টালে সেই সকল তথ্য অনুপস্থিত! সংশয় উত্থাপন করা যেতে পারে যে, অধিকাংশ সংখ্যালঘু নামের ক্ষেত্রেই এমন ভ্রান্তি বা বিভ্রান্তি ঘটে চলেছে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা নিয়ে কেবল প্রশ্ন নয়, একটি তত্ত্ব তৈরি করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
ভারতীয় গণতন্ত্র আজ যে তলে এসে দাঁড়িয়েছে, তা প্রবল উদ্বেগজনক। দেশের ভোটার তালিকা সংশোধন করে মৃত বা স্থানান্তরিত বা ভুয়ো নাম বাদ দেওয়ার প্রয়োজন অনস্বীকার্য— বাস্তবিক তা কোনও নতুন কাজ নয়, গত কয়েক দশক ধরেই তা নিয়মিত ভাবে হয়ে আসার কথা। সে কাজে যদি বিচ্যুতি ও কারচুপি থেকে থাকে, অবশ্যই তার সংশোধন জরুরি। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রক্রিয়াটি যে ভাবে চালিত হচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে, এর উদ্দেশ্য আসলে সংশোধন নয়, সঙ্কোচন। যেন তেন প্রকারেণ ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটেছেঁটে দেওয়া। এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য গণতন্ত্রের পক্ষে হতে পারে না। গণতন্ত্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশবাসীকে অধিকার দান— অধিকার হরণ নয়। বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে কড়া মনোভাব গ্রহণ করেছে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে সক্রিয় হয়েছেন। সংশোধনের নামে যাতে অধিকার হরণের যজ্ঞ না চলে, নির্বাচন কমিশনের তালিকা থেকে যাতে এক জন যোগ্য ভোটারও বাদ না পড়েন, তা নিশ্চিত করার ভার কিন্তু কেবল রাজনীতিকদের নয়, নাগরিক সমাজেরও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)