Advertisement
E-Paper

মঙ্গলালোকে বিরাজ

ঐতিহ্য উদ্‌যাপন কেবল অতীতের অনুকরণ নয়। ঐতিহ্য সতত পরিবর্তনশীল। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো ঐতিহ্যের স্বীকৃতি সেই বিবর্তনেরও স্বীকৃতি।

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২২ ০৬:০১
বাংলার দুর্গাপুজো।

বাংলার দুর্গাপুজো।

ঐতিহ্য উদ্‌যাপন কেবল অতীতের অনুকরণ নয়। ঐতিহ্য সতত পরিবর্তনশীল। পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো ঐতিহ্যের স্বীকৃতি সেই বিবর্তনেরও স্বীকৃতি। কলকাতার বাঘাযতীনের একটি ক্লাব যখন ঘোষণা করে যে, পূজামণ্ডপ থেকে দেহদান, অঙ্গদান বিষয়ে সচেতনতার প্রচার হবে, তখন সেই বিবর্তনের আরও একটি বাঁক দেখা যায়। এই বাঁক বাহির থেকে অন্তরের দিকে— আলোকসজ্জা, মণ্ডপ, প্রতিমার জাঁকজমক থেকে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের সম্পদে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ কাহিনিতে এক বাঙালি গৃহস্থের কথা লিখেছিলেন, যিনি নিজের কন্যার বিবাহের দিনে এক হতভাগ্য বিদেশিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার ফলে উৎসবের অঙ্গে কিছু ঘাটতি হয়েছিল— “যেমন মনে করিয়াছিলাম তেমন করিয়া ইলেকট্রিক আলো জ্বালাইতে পারিলাম না, গড়ের বাদ্যও আসিল না, অন্তঃপুরে মেয়েরা অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন, কিন্তু মঙ্গল-আলোকে আমার শুভ উৎসব উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।” এই মঙ্গল আলোকেরই সন্ধান আজ করতে হবে বাংলার দুর্গাপুজোকে। কারণ পারিপার্শ্বিক মানবসমাজ ও পরিবেশের সঙ্গে সংযোগে তার ঘাটতি রয়ে গিয়েছে আগাগোড়া।

কলকাতার এক-একটি পুজোমণ্ডপ যেন জাদুবলে পরিণত হয়েছে প্রাসাদ, কিংবা মন্দির, কিংবা রাজস্থানি দুর্গে। আলাদিনের জিন রাতারাতিতে মরুভূমিতে শহর তৈরি করার মতো, দুর্গন্ধ নালা, অপরিচ্ছন্ন রাস্তার উপর তৈরি হয়েছে সুদৃশ্য, অপূর্ব কারুকার্যময় মণ্ডপ। এই বিচ্ছিন্নতা হয়তো শিল্পী-কারিগরদের এক ধরনের স্বাধীনতা দিয়েছে। রূপকথার কথকদের মতো, তাঁরা সোনার গাছে রুপোর ফল ফলিয়েছেন অনায়াসে। বিচারকরাও সে ভাবেই সেগুলির উৎকর্ষের বিচার করেছেন— উদ্যোক্তাদের আয়োজনের সীমাকে তাঁরাও তাঁদের বিচারের সীমানা ধরে নিয়েছেন। কিন্তু পুজোকে ঘিরে চমক যত বেড়েছে, দুর্গোৎসব যত প্রসারিত হয়েছে, তত কঠিন হয়ে উঠেছে এই বিচ্ছিন্নতার নির্মাণ। বিশেষত কর্পোরেট সংস্থার প্রবেশ, রাজনৈতিক দলগুলির কার্যত পুজোর দখল নেওয়া, এবং রাজ্য সরকার করদাতার টাকা থেকে পুজোর উদ্যোক্তা ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া— এই বিষয়গুলি দুর্গোৎসবের প্রতি নাগরিক সমাজের দৃষ্টিতে অনেকটাই পরিবর্তন এনেছে। বিশেষত দুর্গোৎসব প্রায় একটি সরকার পোষিত প্রকল্প হয়ে উঠেছে, পুজোর বহু আগে থেকে তাকে ঘিরে নানা নতুন উদ্‌যাপনের সূচনা হয়েছে। তা আর ‘পাড়ার পুজো’ নেই।

ফলে পুজো উদ্যোক্তাদের থেকে আরও কর্তব্যপরায়ণতার প্রত্যাশাও তত গুরুত্ব পেয়েছে। এমন নতুন নতুন প্রত্যাশা বার বার তৈরি হয়েছে এই উৎসবকে ঘিরে। এবং বাঙালির ঐতিহ্য এই যে, তা প্রতি বারই সেই প্রত্যাশায় সাড়া দিয়েছে সফল ভাবে। সম্মান ও স্বীকৃতি অর্জনের এক প্রতিযোগিতা কয়েক দশক আগে কলকাতার পুজোকে চড়া বিনোদনের থেকে পরিশীলিত, রুচিশীল সৃষ্টিশীলতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। তার পর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে আজ বাঙালির লোকশিল্পের পুনরুদ্ধার দেখা যায় প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জায়। আজ সুন্দরের সঙ্গে কল্যাণের, শিল্পের সঙ্গে সমাজসেবার সংযোগ ঘটানো গেলে তা পুজোর যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করবে, তা হবে সেই ‘মঙ্গল-আলোকে’ উজ্জ্বল, যা ক্ষিপ্রগতির, বিচিত্র নকশার আলোকরেখায় মেলে না।

Durga Puja 2022 West Bengal Durga Puja
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy