Advertisement
E-Paper

মেয়েদের ইচ্ছা

সাম্প্রতিক একটি ‘টাইম-ইউজ়’ সমীক্ষা দেখিয়েছে, আজও ঘরের বেতনহীন কাজ মেয়েরা করেন দিনে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি, পুরুষেরা এক ঘণ্টাও নয়।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৫ ০৮:৪২
Share
Save

ভারতের জিডিপি বাড়ানোর একটা সহজ উপায় বাতলেছেন বিশ্ব ব্যাঙ্কের এক শীর্ষ আধিকারিক অ্যানা জুর্ডি। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, শ্রমবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ যদি ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করতে পারে ভারত, তা হলে তার জিডিপি বাড়বে অন্তত এক শতাংশ। তাতে এক দিকে মিলবে বাড়তি সম্পদ, অন্য দিকে আরও সাম্যময় সমাজ। এই পরামর্শ শুনলে মনে পড়ে শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই সংলাপ, “‘লাও’ত বটে, কিন্তু আনে কে?” বহু দিন ধরেই অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, নারীশক্তিকে আরও বেশি কাজে লাগাতে পারলে ভারতের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে। যে বিপুল মানবসম্পদ ভারতের সমাজ কেবল গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত করে রেখেছে, তাকে মুক্ত করতে গেলে ঘা দিতে হয় সেই অচলায়তনে, যার নাম পরিবার। নারীর মেধা, মনন, শ্রম, যৌনতা এবং প্রজনন-ক্ষমতা, সবই ওই একটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করছে। মেয়েটি ‘সংসার’ করে জীবন কাটাতে চেয়েছিল, না কি তার ইচ্ছা ছিল কোনও কাজে নিজেকে নিয়োগ করার, সে প্রশ্ন ওঠার আগেই চাপা দিয়ে দিতে অতি পারদর্শী পুরুষতান্ত্রিক পরিবার। নানা বাধা, অসুবিধা সত্ত্বেও মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার বাড়ছে। সম্প্রতি একটি অসরকারি সমীক্ষায় প্রকাশ, দেশের শহরাঞ্চলের ৮.৯০ কোটি মহিলা রয়ে গিয়েছেন কাজের ক্ষেত্রের বাইরে, এঁদের মধ্যে প্রায় দু’কোটি গ্র্যাজুয়েট বা তারও বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছেন। অনেক মেয়ে জানিয়েছেন, তাঁরা কাজে ইচ্ছুক নন। কেন এই অনিচ্ছা? বুঝতে গেলে তাকাতে হবে আর একটি সমীক্ষার দিকে।

সাম্প্রতিক একটি ‘টাইম-ইউজ়’ সমীক্ষা দেখিয়েছে, আজও ঘরের বেতনহীন কাজ মেয়েরা করেন দিনে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি, পুরুষেরা এক ঘণ্টাও নয়। এর অর্থ হল, যদি একটি মেয়েকে রোজগারের জন্য বাইরে বেরোতে হয়, তা হলে সেই অর্থকরী কাজ তাঁকে করতে হয় গৃহস্থালির কাজ, বয়স্ক ও শিশুদের পরিচর্যার কাজের উপরে, বাড়তি কাজ হিসেবে। এর ফলে কর্মক্ষেত্রে তাঁরা এগোতে পারেন না। সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কর্মরত মহিলাদের ৬৬ শতাংশ নেতৃত্বদানে আগ্রহী, নতুন চাকরি পাওয়া মহিলা-কর্মীদের মধ্যে এই হার আরও বেশি (৭৫ শতাংশ)। কিন্তু সংসারে যথেষ্ট সময় দিতে পারবেন না, এই ভয়ে তাঁরা পিছিয়ে আসছেন। কাজের জায়গাও অবশ্য তাঁদের প্রতি অনুকূল নয়। মেয়েদের নেতৃত্বের পথে বাধা কী, এই প্রশ্নের উত্তরে সর্বাধিক (৩৫ শতাংশ) মহিলা উত্তর দিয়েছেন, পক্ষপাত, অথবা পদোন্নতির নীতিতে অস্বচ্ছতা। অনেকে মনে করেন, নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ তাঁদের নেই, অল্প কিছু মেয়ে নিজের মধ্যে সেই ব্যক্তিত্বও খুঁজে পাননি। যার অর্থ, কাজের ক্ষেত্রটিও পরিবারের একটি ‘শাখা’ হয়ে উঠে মেয়েদের আত্মপ্রত্যয় লাঘব করে।

অথচ মেয়েদের কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধের সুযোগ কাজে লাগায় নানা কর্মক্ষেত্র— খেতমজুরদের দশ জনের সাত জনই মহিলা, চা বাগানে ৯০ শতাংশেরও বেশি, আশা কর্মী ১০০ শতাংশ। তবু মেয়েরা কর্মীর মর্যাদা, বেতন চাইলে তা ‘বাড়াবাড়ি’ মনে হয় সরকার এবং শিল্পের। পুরুষের দ্বিগুণ কাজ, অথচ ঘরে-বাইরে অর্ধেক মর্যাদা— এই অসম্মান এড়াতে বহু মেয়ে কর্মজগতে প্রবেশ করতেই চান না। এ কেবল কাজে অনীহা নয়, অবমাননায় আপত্তি। সরকার, সমাজ তা বুঝেও ক্রমাগত মেয়েদের কর্মনিযুক্তির প্রশ্নকে টেনে আনে দক্ষতা তৈরির প্রকল্পে। পরিবারের সাবেকিয়ানাকে সমর্থন করে মেয়েদের সক্ষমতার বাণী শোনানো, যেন চোরকে চুরি করতে এবং গৃহস্থকে ঘর সামলানোর উপদেশ। মেয়েরা কর্মক্ষেত্রের যোগ্য কি না, সে প্রশ্ন তোলাই ভুল। বরং প্রশ্ন করা চাই, ভারতের পরিবার, কর্মক্ষেত্র, মেয়েদের যোগ্য কি না। শিক্ষিত, দক্ষ মেয়েদের কর্মনিযুক্তি ভারতে কেন চিনের প্রায় অর্ধেক, তার উত্তর দিক ভারতের সরকার আর সমাজ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian Economy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}