E-Paper

অধিকার

সংশয় হওয়া বিচিত্র নয় যে, আধারকে প্রামাণ্য নথি হিসাবে গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনের আপত্তিটি ঠিক আইনি নয়, এমনকি সংবিধানসঞ্জাতও নয়— সে আপত্তির কারণ ভিন্ন, তার শিকড় রাজনৈতিক আনুগত্যে।

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:২৯

গত ১০ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট প্রথম বার নির্বাচন কমিশনকে বলেছিল, বিহারে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের ক্ষেত্রে আধারকে প্রামাণ্য নথি হিসাবে গণ্য করা হোক। তার এক মাস পরে, ১৪ অগস্ট আদালত কমিশনকে নির্দেশ দেয়, বিহারে তালিকা সংশোধনের সময় আধারকে পরিচয় ও বাসস্থানের প্রমাণ হিসাবে গণ্য করতে হবে। তারও আট দিন পরে, অগস্টের ২২ তারিখ আদালত ফের নির্দেশ দেয়, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে, এমন কেউ পুনর্বিবেচনার আর্জি জানালে, আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রামাণ্য নথি হিসাবে আধার জমা দেওয়া যাবে। এই নির্দেশের ১৭ দিন পরে শীর্ষ আদালত কমিশনকে নির্দেশ দিল, ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের জন্য কমিশন-স্বীকৃত ১১টি নথির সঙ্গে আধারকে দ্বাদশতম স্বীকৃত নথি হিসাবে গণ্য করতে হবে। এই ঘটনাক্রম যে দিকে ইঙ্গিত করে, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে গভীর উদ্বেগের— দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন স্পষ্টতই শীর্ষ আদালতের নির্দেশ অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছে দু’মাস ধরে। অভিযোগ উঠেছে যে, আদালতের নির্দেশের পরেও বিহারে বিএলও-রা আধারকে নথি হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন; এমন অভিযোগও উঠেছে যে, যাঁরা নথি হিসাবে আধার গ্রহণ করেছেন, তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশটি যথেষ্ট বিজ্ঞাপিতও হয়নি। ফলে, এই সংশয় হওয়া বিচিত্র নয় যে, আধারকে প্রামাণ্য নথি হিসাবে গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনের আপত্তিটি ঠিক আইনি নয়, এমনকি সংবিধানসঞ্জাতও নয়— সে আপত্তির কারণ ভিন্ন, তার শিকড় রাজনৈতিক আনুগত্যে।

আদালত প্রশ্ন করেছে, কমিশন যে এগারোটি নথিকে প্রামাণ্য হিসাবে বিবেচনা করছিল, সেগুলির মধ্যেও পাসপোর্ট এবং জন্মের শংসাপত্র ছাড়া আর কোনওটিই নাগরিকত্বের চূড়ান্ত প্রমাণ নয়। ফলে, নির্বাচন কমিশন যে যুক্তিতে আধারকে নথি হিসাবে গ্রাহ্য করতে চায়নি, সে যুক্তিতে বাকি ন’টি নথিও গ্রাহ্য হওয়ার কথা নয়। সেগুলিকে যদি গ্রাহ্য করা হয়, তবে আধারকেই বা নথি হিসাবে গণ্য করা হবে না কেন? কমিশনের কাছে এই প্রশ্নের সদুত্তর নেই। বস্তুত, তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার পর পুনর্বিবেচনার আবেদনের সঙ্গে যদি আধারকে গ্রাহ্য নথি হিসাবে গণ্য করা যায়— ২২ অগস্ট আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিল— সেটাই কি নথি হিসাবে আধারের গ্রহণযোগ্যতায় সিলমোহর দেয় না? তার পরও আদালতের নির্দেশের জন্য আরও ১৭ দিন অপেক্ষা করতে হল কেন? আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও কারও মনে হতে পারে, আগের নির্দেশটি দেওয়ার সময়ই কি আধারকে দ্বাদশ নথি হিসাবে গণ্য করার কথা বলা যেত না? অবশ্য, নির্বাচন কমিশনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কেন ন্যায্য কাজটি করার জন্যও আদালতকে বাধ্য করতে হবে, কমিশনের কাছে সেই প্রশ্নটি করা অনেক বেশি জরুরি। কমিশন এ বার শিক্ষা নিক— অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজ্যে ভোটার তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়াটি যাতে আদালতের তিরস্কার ছাড়াই ঠিক পথে চলে, তা নিশ্চিত করুক।

বিহারে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন, এবং নথি নিয়ে গোটা ঘটনাক্রম থেকে আরও একটি কথা স্পষ্ট হয়— গণতন্ত্রকে যথাযথ পথে চালিত করতে হলে সক্রিয় বিরোধী রাজনীতির কোনও বিকল্প হয় না। কমিশনের মনপসন্দ নথির অভাবে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ে অ-নাগরিক হয়ে যাওয়া কিছু মানুষের ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু, তা ক্রমে হয়ে উঠল জাতীয় রাজনীতির অন্যতম বড় প্রশ্ন, কারণ বিরোধী রাজনীতি সেই মানুষগুলির পাশে দাঁড়াল। তাত্ত্বিকরা বলবেন, সব ঘটনাই কক্ষপথ-সাপেক্ষ। ফলে, বিহারে বিরোধী রাজনীতি সদর্থক ভঙ্গিতে সক্রিয় না হলেও কমিশন আজ আধারকে গ্রাহ্য নথি হিসাবে গণ্য করতে বাধ্য হত কি না, সে প্রশ্নটি নিশ্চয়ই অনেককে ভাবাবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Aadhar card Citizenship SIR

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy