E-Paper

বাজির সুলুকসন্ধান

উৎসব মানেই বাজি, এবং ভালবাসা মানেই গোলাপ— এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বহুজ্ঞাত থাকলেও ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট দিন-তিথি-উদ্‌যাপনের সঙ্গে এই দু’টি সম্পর্ককেই যা সর্বমান্য ও সর্বপ্রিয় করে তুলেছে, তার নাম বাজার-সংস্কৃতি।

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৩৩

বাজি নিয়ে বাংলার সমাজ-রাজনীতি সরগরম। ঠাস ঠাস দ্রুম দ্রাম পটকা ফাটানোর খটকা লাগানো শব্দকল্প বাংলার সাহিত্যে অমর। বাঙালি সাহিত্যিকরা, এমনকি রবীন্দ্রনাথও, কম আদিখ্যেতা করেননি হাউই তুবড়ি নিয়ে। কিন্তু বাংলা বাজির ইতিহাস ও ভূগোল আশ্চর্য নীরবতাময়। কবে থেকে দীপাবলির সঙ্গে জড়িয়ে গেল বাজির এই সমারোহ, সে কি বাংলার নিজস্ব উৎসব না কি আমদানিকৃত, এ সব তথ্য মোটে সহজলভ্য নয়। ইতিউতি যেটুকু জানা যায়, তাতে স্পষ্ট কালীপুজোর সঙ্গে বাজির সম্পর্কটি তুলনায় আধুনিক হলেও আতশবাজি উৎসব অন্তত দু’শো বছর যাবৎ বাঙালি জীবনে উপস্থিত। আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যে চিতোর রানা রতনসিংহ ও সিংহলী রাজকুমারী পদ্মাবতীর মিলনোৎসবে আতশবাজির রোশনাই আলো করে দিয়েছিল দিগ্বিদিক। কালীপুজোর সঙ্গে বাজির সম্পর্ক না থাকলেও গবেষকরা বলেন, উনিশ শতকে বাজি পোড়ানোর দিব্য চল ছিল কলকাতার ‘বাবু’-সম্প্রদায়ের মধ্যে। বাবুরা যেমন জাঁকজমক করে পুজো করতেন, ব্যান্ড বাজিয়ে গঙ্গাস্নানে যেতেন, তেমনই প্রদর্শন-প্রসন্নতা লাভ করতেন বহু অর্থব্যয়ে বাজি পোড়ানোর চিত্তাকর্ষক বন্দোবস্তে। অনেকের মতে, উত্তর ভারতের দেওয়ালি উৎসবের অনুষঙ্গেই পশ্চিম থেকে পূর্বে বাংলায় প্রবেশ করেছে দীপাবলির বাজি। এ সব খুঁটিনাটি ছাড়াই একটি অনুমান সহজে করা সম্ভব: দীপাবলির বাজি আসলে ভ্যালেন্টাইনস ডে-র গোলাপ-এর সঙ্গে তুলনীয়। উৎসব মানেই বাজি, এবং ভালবাসা মানেই গোলাপ— এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বহুজ্ঞাত থাকলেও ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট দিন-তিথি-উদ্‌যাপনের সঙ্গে এই দু’টি সম্পর্ককেই যা সর্বমান্য ও সর্বপ্রিয় করে তুলেছে, তার নাম বাজার-সংস্কৃতি।

ক্রমশ সনাতন-আকৃষ্ট হিন্দু বাঙালির আজ এও জানা দরকার যে, উনিশ-বিশ শতকের পথিকৃৎসম বাবুরা কিন্তু আনন্দ-উৎসবের ক্ষেত্রে, বিশেষত ব্যক্তিগত ব্যসনের ক্ষেত্রে, বেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ছিলেন! বহু ক্ষেত্রেই হিন্দু সহধর্মিণী ও মুসলমান বাইজির মধ্যে চলাচলে অভ্যস্ত ছিলেন, প্রবল নিষ্ঠাভরে পূজাচার প্রভৃতি পালন করেই সোজা মুসলমান সহচরদের সঙ্গে বাজি পোড়ানোর ব্যসনেও ছিলেন। বস্তুত বাজি-ঐতিহ্য ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যদি কেউ অনুসন্ধান করতে চান, হয়তো আবারও বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের নতুনতর সূত্র মিলতে পারে। কেননা নানা উৎসব ও বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাজি পুড়িয়ে আড়ম্বর সমগ্র সমাজেরই অভ্যাস ছিল, ধর্মীয় পরিচিতি নিরপেক্ষ ভাবে। বাজি-নির্মাতাদের এক বিরাট অংশ এখনও মুসলমান। প্রসঙ্গত, বর্তমান ভারতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাজিতেও প্রসারিত হয়েছে, পাঁচ বছর আগে মধ্যপ্রদেশে দেবস জেলায় মুসলমান বাজি-বিক্রেতার দোকানে আতশবাজির প্যাকেটের উপর কেন হিন্দু দেবদেবীর ছবি, এই প্রশ্নে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আক্রমণে হিংসাতাণ্ডব বেধেছিল। অথচ ঐতিহ্যগত ভাবেই, কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, সমগ্র ভারতেই যে কোনও উৎসবে বাজির ক্রেতা-বিক্রেতার আদানপ্রদানে আজও নিহিত থাকে কৃত্রিম, অনাবশ্যক, বিপজ্জনক এই ধর্মীয় সীমা মুছে দেওয়ার অলক্ষ্য এক প্রক্রিয়া।

এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়, বাজি বিষয়ে যে সব সাম্প্রতিক ইতিহাস-আখ্যান বাঙালির কাছে প্রিয় হয়েছে, তার মধ্যে এক কেন্দ্রীয় চরিত্র: বুড়িমা। দেশভাগের পর ফরিদপুর থেকে অসহায় অবস্থায় হাওড়ার বেলুড় অঞ্চলে এসে সন্তান প্রতিপালনার্থে একটি ছোট বাজির দোকান দিয়েছিলেন এই প্রৌঢ়া। তখন তিনি জানতেন না, অচিরেই বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবেন তাঁর এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে। ক্রমশ তাঁর বাজির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল, বাংলার মেয়েদের ব্যবসায়িক ব্র্যান্ডের মধ্যে তাঁর দাবি হয়ে দাঁড়াল অতি গুরুতর। তবে এই কথাটিও নিশ্চয় ইতিহাসের পাদটীকায় লিপ্ত থেকে গেল যে তাঁর বাজি বানানোর শিক্ষা কিন্তু বাঁকড়ার আকবর আলির কাছে। ফলে দরিদ্র বাঙালি রমণীর বাজি-ব্যবসার মনোগ্রাহী বুড়িমা-আকবর কাহিনির পরতে পরতে মিশে রইল প্রশ্নাবলি: দেশভাগ কেন, কোন যুক্তিতে, তার ফলে কার কতটা প্রাপ্তি কতখানি ক্ষতি হল, কে কোথায় গেল, কেনই বা গেল, না গেলেও কি চলত ইত্যাদি। এমনকি কারও এও জানার ইচ্ছা হতে পারে যে, পশ্চিম থেকে পূর্বে যখন এল আতশবাজি, তার মধ্যেও কি ইসলামি সমাজের কোনও বিশেষ ভূমিকা ছিল। মোট কথা, বাজি-সংস্কৃতি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক, এ নিয়ে যত কথা হয়, বাজির ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের আলোচনা কিন্তু এখনও বাকি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Crackers Kalipujo 2025 deepabali Harmony

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy