লজ্জা বস্তুটির চরিত্র এমন, না চাইলে যার অস্তিত্ব থাকে না। সুতরাং অনেকেই ভাবেন, লজ্জা প্রকৃতপক্ষে একটি অ-বস্তু, যার অস্তিত্ব অনিবার্য নয়। তাঁদের কাছে লজ্জাহীনতাই হল একমাত্র দস্তুর। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে এই ভাবে চলাই সাব্যস্ত করেছে। যা-ই হোক না কেন, যতই মুখ পুড়ুক না কেন, দুর্নীতি দুরাচারের সমূহ গতি যতই আকাশ-পাতাল বিদীর্ণ করুক না কেন, মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকার স্থির করেছেন তাঁরা থাকবেন অলজ্জ ও অবিচল। নতুবা হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট উভয় তরফে প্রবল থেকে প্রবলতর ভর্ৎসনার পরও তাঁরা এত অলজ্জিত স্পর্ধা সহকারে চলতে পারতেন না। ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের হয়ে এত ওকালতি ও এত বন্দোবস্তের চিন্তা করতে পারতেন না। বিচারপতিরা যথার্থই প্রশ্ন করেছেন, ‘অযোগ্য’দের নিয়ে এতখানি সরকারি উদ্বেগের রহস্যটি কী, তাঁরা কোন কারণে রাজ্যের এমন নয়নমণি। বিচারপতিদের বক্তব্যের অভিমুখটি লক্ষণীয়: কোনও একটি ‘গভীর কায়েমি স্বার্থ’ ছাড়া তো রাজ্য সরকার দাগিদের ফের পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিতে পারত না! তা ছাড়া কেনই বা আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও দাগি প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এও আদালতের বক্তব্যে স্পষ্ট করা হয় যে, এ মাসের প্রথম দু’টি রবিবার যে পরীক্ষা নির্ধারিত হয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে আসা যাবে না। লজ্জাহীন রাজ্য সরকার তাতেও আপত্তি জানিয়ে বলেছিল— প্রস্তুতির জন্য আরও সময় লাগবে। তাতে আবারও বকুনি খেতে হয় তাঁদের, দরকারে রাত জেগে প্রস্তুতি নেওয়ার উপদেশও শুনতে হয় সর্বোচ্চ আদালতে। কিন্তু কিসেই বা কী, রাজ্য সরকার অবিচলিত। দাগিদের ফের পিছনের দরজা দিয়ে নিয়োগ করার চেষ্টা চলছে, যুগপৎ আদালত ও জনসমাজের এই পর্যবেক্ষণের সামনে সরকারি আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব— এ সব নেহাত অভিযোগ।
সরকারি আইনজীবী আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে অকুতোলজ্জায় জানিয়েছেন, দাগি প্রার্থীর তালিকা শীঘ্র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রশ্ন, তালিকা যদি এমনই প্রস্তুত তাকে, তা হলে কেন তা যথাস্থানে প্রেরিত হল না, দাগিদের সঙ্গে যোগ্যদের তালিকাও কেন প্রকাশ করা গেল না, কেন মুড়িমিছরি নির্বিশেষে ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি আদালতের নির্দেশে খারিজ হয়ে গেল। প্রশ্নই সার। উত্তর নেই। উত্তরহীনতার মূল্য ধরে দেওয়ার কোনও দায়ও নেই।
বস্তুত, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষক নিয়োগের যে বিশাল কেলেঙ্কারি এই রাজ্যে উদ্ঘাটিত, তার পরে রাজ্য সরকারের হাবভাব সম্পর্কে একটি শব্দই প্রযোজ্য— লজ্জাহারা। সরকারি শিক্ষকতার চাকরির গগনচুম্বী আর্থিক দুর্নীতি ইতিমধ্যেই প্রকাশিত, প্রমাণিত। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী জেলনির্বাসিত। এও অনুমিত যে তৃণমূল কংগ্রেসের উচ্চতম মহলের সিলমোহর ছাড়া এত ব্যাপক ও বিপুল দুর্নীতি ঘটা সম্ভব ছিল না। এই দুর্নীতিকোপে আজ রাজ্যব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে, ছাব্বিশ হাজার যোগ্য-অযোগ্য শিক্ষক এক সঙ্গে বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে শিক্ষকবিহীন হয়ে পড়েছে স্কুলগুলি। সঙ্গে সঙ্গে বহু সহস্র পরিবার অসহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েছে। কেউ বলতেই পারেন, ‘দাগি’ শিক্ষকদের আজকের অসহায়তা তো নিয়তিনির্দিষ্ট। উত্তরে বলতে হয়, নিয়তি নয়, তাঁদের পরিস্থিতি— সরকারনির্দিষ্ট। যাঁরা দাগি নন— যোগ্য কিংবা সুযোগবঞ্চিত, তাঁদের অসহায়তাও সরকারনির্দিষ্ট। যে ব্যবস্থায় অন্যায়ের এই বিস্তৃত ব্যবস্থা বিছিয়ে রাখা আছে, তার ফাঁদে সাধারণ মানুষ পড়বেন, এতে আর আশ্চর্য কী। গত এক দশকাধিক কালে এই রাজ্যে বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতির মধ্যে বার বার সাধারণ মানুষই শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু যাঁদের ‘বদান্যতা’য় ও সযত্ন-সাধনায় এই সব কুনাট্য ঘটতে পেরেছে, তাঁরা এর মূল্য ধরে দেননি, লজ্জাটুকুর ধারও ধারেননি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)