প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র।
রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতির পণ্ডিতরা বলছেন, আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা সত্তা-রাজনীতিই বর্তমান সময়ের একমাত্র বাহক নয়। তার আর একটি অতি ঘনিষ্ঠ সহচর আজকের বিশ্বরাজনীতির আনাচকানাচে বিশেষ প্রভাব বিস্তারকারী— যার নাম ‘ভিকটিমহুড পলিটিক্স’, বা আহত-সত্তার রাজনীতি। শুনতে কঠিন হলেও বিষয়টি অতি সহজ। সত্তা বস্তুটি তো কেবল নিজের পরিচিতিতেই শেষ হয় না। কেন সেই পরিচিতির ফলে তাকে এ-যাবৎ রাজনীতি বা সমাজ বা অর্থনীতিতে প্রান্তিক থাকতে হয়েছে, এই বয়ানটি যে কোনও সত্তা-রাজনীতিরই প্রাথমিক ও মৌলিক ধাপ। সেই কারণেই, সত্তাই সব নয়, সত্তার আহত ভাবটিও অত্যন্ত জরুরি। এই আহত-সত্তার বক্তব্য, অবস্থান ও প্রদর্শনকে একত্রে বলা যেতে পারে ‘ভিকটিমহুড ন্যারেটিভ’ বা আহত-সত্তার আখ্যান। ভারতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন আহত-সত্তার আখ্যান প্রবল শক্তিতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ভোটের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছে। ‘ভাবাবেগ’ শব্দটি আর কেবল সংখ্যালঘু বা প্রান্তিকের নিজস্ব নয়— যে প্রবল, যে সংখ্যায় গুরু বা অধিক, এখন তারও কাছে ভাবাবেগ বা স্বার্থরক্ষা শব্দগুলি অতীব জরুরি। কেননা, সেই আহত-সত্তার রাজনীতির মুদ্রাতেই তাকে ভোট ছিনিয়ে আনতে হয়। বাম দক্ষিণ মধ্যই হোক, কিংবা সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুই হোক, কিংবা অনুন্নত উন্নত সমাজই হোক— সকলেই এখন সকলের দিকে আড়চোখে চায়, পরস্পরের বিরুদ্ধে নিজের আহত-সত্তার অভিযোগ উৎক্ষেপ করতে চায়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, গত আট বছরের দেশশাসক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও যে তাঁর আহত-সত্তার কথাই জনসমক্ষে ঘটা করে বলবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। মোদী বলেছেন, তাঁকে কেবল গালি খেয়েই দিনযাপন করতে হয়, গালি থেকেই তিনি তাঁর প্রতি দিনের রসদ সংগ্রহ করেন। তেলঙ্গানায় দাঁড়িয়ে এই আহত আবেগ প্রদর্শনের মধ্যে অনেকে দেখছেন তাঁর ভোটকাতরতা, ভাবছেন যে নিশ্চয়ই তাঁর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে রাজ্যে দুর্বল বলেই এই কাতরতা দেখানো। আবার, কংগ্রেস নেতা কানহাইয়া কুমার মোদীকে এক হাত নিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, কী এসে যায় গালি খেলে, যখন ভোটবাক্সে মোদীর নামে এমনিতেই উজাড় হয়ে যাচ্ছে জনমত! আসল কথা, কাতরতা কিংবা উদ্দেশ্যহীন নাট্যপ্রিয়তা, কোনওটা দিয়েই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ‘আহত-সত্তা সিনড্রোম’ বোঝা যায় না। এর পিছনে সহজসরল ভোটের অঙ্ক না-ও থাকতে পারে। বরং এর পিছনে প্রধান উদ্দেশ্য, হারজিত সর্ব পরিস্থিতিতেই একটি রাজনৈতিক ‘অপর’ শক্তিকে কোনও না কোনও ভাবে জিইয়ে রাখা। একমাত্র তাতেই শেষ পর্যন্ত ভোট-রাজনীতি এবং ভোটোত্তর-রাজনীতির মোক্ষ সাধন সম্ভব।
সুতরাং, যে দেশে দুই-দুই জন প্রধানমন্ত্রীকে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে, যে দেশের আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিককে আততায়ীর গুলিতে জীবন দান করতে হয়েছে, সে দেশে, এবং সেই সকলেরই বিপরীত রাজনীতির তলে দাঁড়িয়ে, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার আঁচে জারিত হতে হতেও কেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে ‘ভিকটিম’ প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন, বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে দেশের নাগরিক কেবল আহত-সত্তার আর্তনাদেই সাড়া দেন, সে দেশে যাঁর সংখ্যার জোর বেশি, গলার জোর বেশি, তাঁর আর্তনাদও বেশি হবে, এবং নাগরিক সমাজ তাঁকেই আলিঙ্গন করবে। ফলে প্রশ্নটা আপাতত ঘুরিয়ে দেওয়া জরুরি। রাজনৈতিক নেতাদের অন্যায়ের দায় রাজনৈতিক সমাজকেই নিতে হবে। তাই, কেন ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং মিথ্যাচারণে পরিপূর্ণ রাজনীতিকেই এ দেশে প্রকৃত মানবোন্নয়নের রাজনীতির অপেক্ষা শ্রেয় ও বাঞ্ছনীয় মনে করা হবে, সে উত্তর বরং ভারতীয় নাগরিক তথা ভোটদাতার কাছেই চাওয়া যাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy