হনুমানই ছিলেন বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী— স্কুলছাত্রদের বললেন বিজেপি সাংসদ অনুরাগ ঠাকুর। ছাত্ররা বিশ্বাস করল কি না, জানা নেই। তবে হিন্দুরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎনাগরিক হিসাবে সাংসদের কথায় বিশ্বাস করা তাদের অবশ্যকর্তব্য। অস্বীকার করা যাবে না যে, বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা জ্ঞানচর্চার একটি বিশিষ্ট ধারা তৈরি করে ফেলেছেন। তাত্ত্বিকরা হয়তো বলবেন, এই জ্ঞানচর্চার ধারার মূলে রয়েছে ‘মাল্টিভার্স’ তত্ত্ব— অর্থাৎ, একাধিক ব্রহ্মাণ্ড রয়েছে, যার একটিতে কোনও ঘটনা সম্পূর্ণ অসম্ভাব্য হলেও অন্য কোনওটিতে তা ঘোর বাস্তব, এবং নিতান্ত স্বাভাবিক। যেমন, সাধারণ ভারতবাসী যে ব্রহ্মাণ্ডটিকে এত দিন অদ্বিতীয় জ্ঞান করত, সেখানে প্রথম মহাকাশচারীর নাম খুঁজলে ঠিক উত্তরটি হত ইউরি গ্যাগারিন। ১৯৬১ সালে ভস্তক-এক নভোযানে চেপে মহাকাশে গিয়েছিলেন তিনি। অনুরাগ ঠাকুর যে ছাত্রদের প্রশ্নটি করেছিলেন, তারা গ্যাগারিনের নাম করেনি বটে, কিন্তু নিল আর্মস্ট্রংয়ের নাম উল্লেখ করেছিল— তিনি চাঁদের মাটিতে পা ফেলা প্রথম মানুষ। কিন্তু, হিন্দুরাষ্ট্রের ব্রহ্মাণ্ডে এ সব তথ্য নিতান্ত গুরুত্বহীন। হিন্দুরাষ্ট্রে স্যারিডন না থাকলেও স্বর্গ আছে। সেখানে ইতিহাস বললে লোকে বলিউডের সিনেমা বোঝে, বিজ্ঞান বললে গুলগল্প। ময়ূরের চোখের জলে মিলন থেকে গোমূত্রে সোনা বা ক্যানসারের ওষুধ, অথবা গণেশের মাথার প্লাস্টিক সার্জারি থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দুত্ববাদীদের অবদান, সব বিষয়েই হিন্দু ব্রহ্মাণ্ডের ‘সত্য’ পৃথক। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন, এই উত্তর-আধুনিক কালখণ্ডে ‘সত্য’ কী, অথবা এই উত্তর-সত্য যুগে ‘সত্য’ বস্তুটির আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কি? হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারীরা তাঁদের যথার্থই মনে করিয়ে দেবেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি’। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে থাকলে বিজ্ঞান থেকে ইতিহাস, সবই নিজেদের সুবিধামতো পাল্টে নেওয়া যায়, রচনা করা যায়।
সমস্যা হল, রাজনীতির এই মাল্টিভার্সে বিবিধ ‘ওয়র্মহোল’ রয়েছে, যার মাধ্যমে একটি ব্রহ্মাণ্ড সংযুক্ত থাকে অপরাপর ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে। যেমন, বিজ্ঞানপ্রযুক্তির দুনিয়া এখনও বৈদিক জ্ঞানকে মানতে নারাজ— সে দুনিয়া এখনও যে কোনও দাবিকে স্বীকার করার আগে তার পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ চায়; পুনঃপরীক্ষাযোগ্য তত্ত্বকাঠামো চায়। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রাণপণে গোমূত্রের মহিমাকীর্তন করতে পারে— কিন্তু যত ক্ষণ না সেই দাবিগুলি যথাযথ প্রমাণ-সহ পেশ করা হচ্ছে, তত ক্ষণ অন্যান্য ব্রহ্মাণ্ডে তার কোনও দাম নেই। হিন্দুরাষ্ট্রের যুগন্ধররা এই কথাটি জানেন না, এমন দাবি করা যাবে না; মানেন না, তাও বলা মুশকিল— তাঁদের অনেকের সন্তানসন্ততিই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত। সেখানে পাঠ্যক্রমে নিশ্চয়ই হলদিঘাটের যুদ্ধে রানা প্রতাপের জয়, অথবা হনুমানের মহাকাশযাত্রা পড়ানো হয় না। কিন্তু, সেই নেতারাই যখন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রমে হস্তক্ষেপ করেন, তখন সেখানে ঘোষিত হয় হিন্দুরাষ্ট্রের জ্ঞানতত্ত্বের জয়জয়কার। দুর্জনের মনে সন্দেহ হতে পারে, “দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না কেবল মিচ্কেমি করে?” অনুরাগ ঠাকুরের মতো নেতারা কি সত্যিই বিশ্বাস করেন এই কথাগুলিতে, না কি এগুলি শুধু পিছিয়ে থাকা দেশবাসীর জন্য বলা— যাতে, প্রকৃত শিক্ষার, চেতনার আলো কখনও তাঁদের কাছে পৌঁছনোর ফাঁকটুকু না পায়? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলে স্বেচ্ছাচার যে সহজতর হবে, সে কথা কে না জানে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)