এ বার ব্রিটেন। অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া নীতি প্রণয়নে সক্রিয় হয়েছে প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের সরকার। বস্তুত, গত কয়েক দশক ধরেই অভিবাসন একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনে। ২০১০ সালের মধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বার্ষিক মোট অভিবাসন এক লক্ষের কম করার অঙ্গীকার করলেও, পরের চারটি কনজ়ারভেটিভ সরকারই সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি। বস্তুত, ইইউ থেকে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে সরকারের অক্ষমতার উপরে মানুষের ক্ষোভই ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গোষ্ঠী ছেড়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) নির্বাচনের অন্যতম কারণ ছিল। তাতেও ভিন দেশিদের অনুপ্রবেশ রোধ করা যায়নি। বরং সম্প্রতি হাজার হাজার অভিবাসীর অবৈধ ভাবে ব্রিটেনে প্রবেশের ঘটনা সীমান্তের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আরও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কঠোর অভিবাসন নীতির কথা বলে আঞ্চলিক নির্বাচনে দুর্দান্ত জয় পেয়েছে চরমপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজের দল। এমতাবস্থায় স্টার্মারের নতুন অভিবাসন নীতির নেপথ্যে ভোট রাজনীতির ভূমিকাই প্রধান।
সরকারের নতুন অভিবাসন নীতির অন্তর্গত বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন, অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য ন্যূনতম বসবাসের সময়সীমা বর্তমানের পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে দশ বছর করা হল। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনে গ্র্যাজুয়েট ভিসায় স্পনসরবিহীন অবস্থায় দু’বছর থাকতে পারত। তা কমিয়ে আনা হল আঠারো মাসে। শুধু তা-ই নয়, তাদের পড়াশোনা শেষে কাজের অধিকারও হ্রাস করা হয়েছে। তা ছাড়া, এই প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীলদের জনগণের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য ইংরেজিতে দক্ষতা প্রদর্শন করতে হবে। অন্য দিকে, এই বছর নিম্ন দক্ষ ভিসা কমানো হচ্ছে ৫০,০০০। আবার, স্বাস্থ্য পরিষেবায় নতুন বিদেশি আবেদনকারীদের জন্য ‘হেলথ অ্যান্ড কেয়ার ওয়ার্কার ভিসা’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষণীয়, ব্রিটেনে শিক্ষার্থী এবং দক্ষ কর্মী ভিসা আবেদনকারীদের মধ্যে এক বড় অংশ হলেন ভারতীয়রা। এমতাবস্থায় গ্র্যাজুয়েট ভিসার মেয়াদ হ্রাস ভারতীয় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরে আন্তর্জাতিক স্তরে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগকে প্রভাবিত করবে। অন্য দিকে, হেলথ অ্যান্ড কেয়ার ওয়ার্কার ভিসা বন্ধ হওয়ায় বহু সম্ভাব্য ভারতীয় অভিবাসী কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাবেন।
স্টার্মারের লেবার দলের আশা, এই পদক্ষেপ তাদের প্রতি আমজনতার আস্থা ফেরাতে সাহায্য করবে। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, দেশের অধিকাংশ মানুষ চান সরকার অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে আরও কড়া পদক্ষেপ করুক। বিশেষত চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে, যারা ফ্রান্স থেকে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে শরণার্থীদের ব্রিটেনে নিয়ে আসছে। অথচ, স্টার্মারের নতুন নীতি মূলত বৈধ অভিবাসনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সরকারি পরিষেবা আজও অভিবাসনের উপরে নির্ভরশীল। ফলে, চিকিৎসা-সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে, যেখানে কর্মী অপ্রতুলতা আজও বিদ্যমান, অভিবাসী কর্মী ভিসার সংখ্যা হ্রাসে অসম্মত অনেকেই। অভিবাসন ইতিমধ্যেই উন্নত দেশগুলির সমাজ ও রাজনীতিতে অন্যতম মূল বিভাজনকারী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আশঙ্কা, একুশ শতক এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তা একেবারে চরম বিভাজন ও বিদ্বেষের উৎস হয়ে উঠবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)