এক কোটি চার লক্ষ বাহান্ন হাজার দু’শো চার টাকা। মুম্বইয়ে ভারতীয় মুদ্রায় এই অর্থমূল্যে নিলামে বিক্রি হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়া ‘একমাত্র ভাস্কর্য’। ছোট্ট পাথরের টুকরো কুঁদে, হৃদয়ের আকার দিয়ে, তাতে নিজহাতে একটি পঙ্ক্তি খোদাই করেছিলেন, “পাষাণহৃদয় কেটে খোদিনু নিজের হাতে/ আর কি মুছিবে লেখা অশ্রুধারাবারি-পাতে।” তখন বয়স বাইশ, ১৮৮৩ সালে কর্নাটকের কারওয়ারে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কিছু দিন থাকাকালীন এই শিল্পকৃতির জন্ম। উত্তরকালে যিনি বন্দিত হবেন কবিগুরু, নোবেলবিজয়ী বিশ্বকবি হিসাবে, জীবনের শেষ পর্বে চিত্রকলাতেও যাঁর স্বতন্ত্র কৃতির সাক্ষী থাকবে সারা পৃথিবী, তাঁর হাতের এই একমাত্র ভাস্কর্যের ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। প্রায় দেড়শো বছর পুরনো ভাস্কর্যটির আর্থিক গুরুত্বও কম নয়; নিলামে উঠল বলেই জানা গেল, গোড়ায় তার দাম ৫৫ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা ধরা হয়েছিল, বিক্রির সময় এক কোটি ছাড়িয়েছে। নিলামে উঠেছিল ১৯২৭-৩৬ সময়কালে রবীন্দ্রনাথের লেখা ৩৫টি চিঠিও, সেগুলি বিক্রি হয়েছে মোট ৫ কোটি ৯০ লক্ষ টাকায়!
ভাস্কর্যটির নিলামে ওঠা ও তার বিক্রয়মূল্য খবরের শিরোনাম হয়েছে। সমাজমাধ্যমে আলোচনায় মিশে আছে বিস্ময় ও আক্ষেপ: রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যও শেষে কিনা নিলামে উঠল! কেউ ঘটনাটিকে দেখেছেন জাতিগত আত্মসমালোচনার আলোয়— বাঙালি শুধু আত্মবিস্মৃত জাতিই নয়, নিজের শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্যমূল্যের ‘দাম দিতে না পারা’ জাতি, নইলে এ জিনিস কেউ নিলামে উঠতে দেয়! কেউ কড়া সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের হাতে-গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের— কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কি নৈতিক দায়িত্ব ছিল না, অন্য অগণিত রবীন্দ্র-স্মারকের মতোই এই ভাস্কর্যটিও যাতে সেখানকার সংগ্রহশালায় স্থান পায় সেই লক্ষ্যে ঝাঁপানো? অনেকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক লাফে পৌঁছেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগে, ভারত সরকারের কি উচিত ছিল না এই ঐতিহ্যময় শিল্পবস্তুকে নিলামে ওঠা থেকে বিরত করা? পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকার কি এ ব্যাপারে কেন্দ্রকে অনুরোধ করতে পারতেন না?
সাধারণ্যের একাংশ ভাস্কর্যটির নিলামে ওঠা ও বিক্রি হয়ে যাওয়াকে দেখছেন এক জাতিগত সম্পদ ধরে রাখতে না পারার অক্ষমতা হিসেবে। কোনও বড় লেখক বা অধ্যাপকের প্রয়াণের পর যখন শোনা যায় তাঁর বিপুল অমূল্য বই-সংগ্রহ জলের দরে বিক্রি হয়ে গেছে বা রাস্তায় নষ্ট হচ্ছে; খ্যাতিমান ব্যক্তির প্রাচীন বাসগৃহ ভেঙে যখন দেখা যায় সেখানে বহুতল উঠছে, তখন যে ক্ষতির দুঃখ ও অপরাধবোধ গ্রাস করে, তারই সমার্থক হিসেবে তাঁরা দেখছেন এই নিলামকে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির বোধ আরও গভীর, কারণ এখানে কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর স্বহস্তখোদিত ভাস্কর্য নির্ঘাত দেশের বাইরে চলে যাবে চিরতরে। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া উপহারসূত্রে যাঁদের কাছে জিনিসটি কয়েক প্রজন্ম ধরে ছিল, তাঁরাও হয়ে উঠছেন গণক্ষোভের লক্ষ্য। অথচ আবেগের তাড়নায় এই তথ্য চাপা পড়ে যাচ্ছে যে, ভাস্কর্যটি এত কাল বরং ছিল বিদেশে, আমেরিকার এক ব্যাঙ্কের লকারে। তার অধিকারীরা চাইলেই সেটি বিদেশের তাবড় নিলাম সংস্থায় তুলতে পারতেন, বরং তাকে ভারতের ‘জাতীয় সম্পদ’ বিবেচনায় তাঁরা দেশে ফিরিয়েছেন, দেশেই নিলামের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে নিয়মানুযায়ী তা দেশেই থাকে। আম-ভারতীয় তথা বাঙালি যে নিলাম ব্যাপারটিকে নেতির আলোয় দেখেন তার একটি ঔপনিবেশিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত আছে, তাঁদের কাছে কোনও কিছু ‘নিলামে ওঠা’ মানে কোনও পরিবার-শ্রেণি-গোষ্ঠী বা জাতির চরম আর্থিক অপারগতা হেতু সম্পদ ও সম্মানের হানি। অথচ শিল্পমহলে নিলাম এক সহজ ঘটনা, বিশ্বখ্যাত লেখক-শিল্পীর কাজ নিলামে উঠবে, বিকোবে, উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে যোগ্য সংগ্রাহক তথা পৃষ্ঠপোষকের কাছে যত্নে রক্ষিত হবে, এও স্বাভাবিক। এও মনে রাখার, বিখ্যাত মানুষের শিল্পবস্তু নিলামের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় সম্পদ’-এর বিষয়টি অতীব গুরুত্বে বিবেচিত হয়; এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুন ও বিধিনিষেধের বিস্তর কড়াকড়ি সব দেশেই, ভারতেও। আসলে মহার্ঘ বা বিরল শিল্পবস্তু নিলামের ক্ষেত্রে ক্রেতার নাম-পরিচয় গোপন থাকে বলেই হয়তো মানুষের মধ্যে তা চিরতরে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা বাড়ে। এই ভাস্কর্য শেষাবধি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র-সংগ্রহশালায় থাকলে ভাল হত নিশ্চয়ই, তবে আপাতত দেশের মধ্যেই কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে সযত্নে রাখা থাকবে, এই আশাটুকুই এখন বাঙালির সম্বল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)