দুই সপ্তাহের মধ্যে ‘এত আপত্তি কেন’ থেকে ‘আপত্তি থাকলে ভেবে দেখা যেতে পারে’— এই ভাবে যদি অবস্থান পাল্টায়, তা হলে পুনর্বিবেচনার দাবি যাঁরা তুলেছিলেন,তাঁদের অন্তত আংশিক জয় সূচিত হল, এমন বলা যেতেই পারে। এসআইআর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু থেকে। ১৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি সম্বলিত যে বেঞ্চ এই বিষয়-সংক্রান্ত অভিযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের প্রতিক্রিয়া ছিল— এত অভিযোগ বিস্ময়কর, মনে হচ্ছে আগে দেশে কখনও এই প্রক্রিয়া হয়নি। এ দিকে তামিলনাড়ুর শাসক দল ডিএমকে-র পক্ষে আইনজীবী কপিল সিব্বল অভিযোগ তোলেন যে আগে কখনও এমন অস্বাভাবিক তাড়ার সঙ্গে এই প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়নি। এ বার তাড়ার জন্যই প্রভূত ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা। সমগ্র বিষয়টি একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। কেবল জনসংখ্যার বিপুলতাই তো নয়, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ফোর-জি বা ফাইভ-জি টেলিপ্রযুক্তির অপ্রতুলতাও গুরুত্বসহকারে বিচার্য— সিব্বলের সঙ্গত যুক্তি। এরই পুনরুচ্চারণ শোনা গেল পশ্চিমবঙ্গের তরফে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের মুখেও। সম্প্রতি, ২৬ নভেম্বর, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর বেঞ্চ জানাল— নির্বাচন কমিশনকে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের সময়সীমা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে, যদি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য যুক্তি থাকে।
কোন যুক্তি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য, তা অবশ্যই একান্ত ভাবে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচার্য। তবে বিরোধীদের দ্বারা উত্থাপিত বলেই এসআইআর প্রক্রিয়া সংক্রান্ত অভিযোগগুলিকে অবজ্ঞা/উপহাস করা ও সমূলে ধামাচাপা দেওয়ার যে রাজনৈতিক পথ শাসক দল বিজেপি গ্রহণ করেছে, তা অতীব দুর্ভাগ্যজনক। শাসক/বিরোধী দ্বৈরথের বাইরে গিয়ে যুক্তিগুলির যাথার্থ্য ও গুরুত্ব বিচার অত্যন্ত জরুরি, কেননা এর সঙ্গে দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের ভাগ্য ও অধিকার জড়িয়ে রয়েছে। দুই বিরোধী-শাসিত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ু পরস্পরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এসআইআর বিরোধিতার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাসকের সঙ্গে দ্বৈরথে প্রবৃত্ত, এতটা ভাবা কঠিন। সেই কারণেই দুই রাজ্য থেকে উত্থিত অভিযোগগুলির সাদৃশ্য বিশেষ অনুধাবন সহকারে বিচার্য। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং তার সঙ্গী রাজনৈতিক দলগুলি এক স্বরে তীব্র প্রতিবাদে শামিল— এসআইআর-এ তাড়াহুড়ো ও অস্বচ্ছতার ফলে ভোটার তালিকায় অন্যায় ভাবে নাম বাতিল ও নতুন নাম সংযুক্তির সমান্তরাল প্রক্রিয়া চলছে, তাদের দাবি। এবং সেই প্রক্রিয়া এমন ভাবে চালিত হচ্ছে যাতে সংখ্যালঘু ও তফসিলি জাতি-জনজাতি গোষ্ঠীগুলি থেকেই ভোটারসংখ্যা কমে। ডিএমকে জানিয়েছে, তারা নিশ্চিত যে ঘুরপথে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি-র কাজ শুরু হয়েছে। ডিএমকে-র পিটিশন বিশেষ জোর দিয়েছে নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় সাধারণ মানুষের উপর চাপানোর ঘোর অনৈতিকতার উপর, ঠিক যেমন করা হয়েছিল অসমের এনআরসি-তে। এমডিএমকে নেতা ও প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদ ভাইকোর পিটিশনে কঠিনতর ভাষায় বলা হয়েছে এসআইআর-এ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হননের কথা, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন এবং নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ক আইন খণ্ডনের কথা। ভাইকোর অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টে তালিকাবদ্ধ হওয়ায় নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়াও আহূত হয়েছে।
প্রকৃত মুশকিল অবশ্য নির্বাচন কমিশনের ভাবে ও ভঙ্গিতে। কমিশনকে এর আগেও সুপ্রিম কোর্ট একাধিক বার নির্দেশ দিয়েছে অভিযোগের উত্তর দিতে। একাধিক বার সেই নির্দেশ লঙ্ঘিত বা অবহেলিত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশচালিত বটে, কিন্তু শেষ অবধি তা একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক গোষ্ঠী নয়। বর্তমান ভারতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক দলীয়তা-আবদ্ধ হয়ে উঠছে— প্রকৃত সঙ্কট সেখানেই। একেই কি বলে গণতন্ত্র?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)