E-Paper

ভোগবাদের উচ্ছিষ্ট

কোনও পরার্থপরতা নয়, দুনিয়ার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে ধনতন্ত্রের মুনাফা অর্জনের নির্বিকল্প তাগিদের ফলেই। কিন্তু, সেই ‘অখিল ক্ষুধা’ই তৈরি করেছে এক অভাবনীয় সঙ্কট।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৫:২৮

অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?” ধনতন্ত্রের চরিত্র বর্ণনা করতে চাইলে এর চেয়ে মোক্ষম বাক্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গোড়াতেই স্পষ্ট করে দেওয়া যাক, এ নিবন্ধ ধনতন্ত্রের সমালোচনা নয়— তাকে নস্যাৎ করার প্রয়াস তো নয়ই। অনস্বীকার্য যে, বর্তমান পৃথিবীর সার্বিক সমৃদ্ধি যে ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, তা সম্ভব হয়েছে ধনতন্ত্রের কারণেই। এই আর্থিক ব্যবস্থার প্রশ্নাতীত সাফল্যের একটিই কারণ— তার অপরিসীম ক্ষুধা। কোনও পরার্থপরতা নয়, দুনিয়ার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে ধনতন্ত্রের মুনাফা অর্জনের নির্বিকল্প তাগিদের ফলেই। কিন্তু, সেই ‘অখিল ক্ষুধা’ই তৈরি করেছে এক অভাবনীয় সঙ্কট। পৃথিবী জুড়ে উৎপাদন শৃঙ্খল ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে উৎপাদনের পরিমাণ। বিজ্ঞাপন প্রভাবিত করছে ক্রেতাকে— কোনটি প্রয়োজন, আর কোনটি নিতান্তই বাসনা, সে ফারাক ভুলতে সাহায্য করেছে মানুষকে। এবং, বৈশ্বিক জনসংখ্যার অন্তত একটি অংশের হাতে ক্রমে বেড়ে চলেছে ক্রয়ক্ষমতা, ফলে পণ্যের বিক্রিও বেড়েছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। ধনতন্ত্রের প্রক্রিয়া গতিশীল থেকেছে, কিন্তু সেই উৎপাদিত ভোগ্যপণ্য ক্রমে পরিণত হয়েছে পাহাড়ে— বর্জ্যের পাহাড়। কিছু ক্ষেত্রে বর্জ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি ভোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে— নরম পানীয় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্লাস্টিকের বোতলটি পরিণত হয় বর্জ্যে; অথবা, যে প্যাকেটে মুড়ে কোনও পণ্য বাড়ি অবধি আসে, বাড়িতে পৌঁছনোমাত্র সেই প্যাকেটের কাগজ থেকে থার্মোকল, সবই বর্জ্যে পরিণত হয়। অন্য দিকে, দীর্ঘায়িত ভোগের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও পণ্যটি বর্জ্য হয়ে ওঠে— জামাকাপড় থেকে মোবাইল ফোন, কলম থেকে গাড়ি, সবই কালক্রমে বর্জ্যে পরিণত হয়। উৎপাদন যত বাড়ে, ভোগ যত বাড়ে, বর্জ্যও তত বাড়ে।

বর্তমানে গোটা দুনিয়ার অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে এই ক্রমবর্ধমান বর্জ্য। তার মধ্যে যেমন প্লাস্টিক রয়েছে, যা প্রভাব ফেলছে গোটা দুনিয়ার বাস্তুতন্ত্রে, খাদ্য-পানীয়-শ্বাসবায়ুতে মিশে প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে; তেমনই রয়েছে ইলেকট্রনিক বর্জ্য, যার মধ্যে উপস্থিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশছে পরিবেশে। এবং, বর্জ্যের প্রাথমিক অভিঘাতটি পড়ছে এমন জনগোষ্ঠীর উপরে, বর্জ্যের উৎপত্তিতে যাদের অবদান তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। স্থানীয় ভাবেও, দরিদ্র মানুষের বসতির কাছ ঘেঁষেই জমে ওঠে বর্জ্যের স্তূপ। আবার, আন্তর্জাতিক স্তরেও, উন্নত দুনিয়া থেকে জাহাজ-বোঝাই বর্জ্য রওনা দেয় আফ্রিকা বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্দেশে। সেখানে ডাম্পিং করা হয় উন্নত বিশ্বের ভোগবাদের উচ্ছিষ্ট। যদিও, শেষ অবধি রেহাই মেলে না কারও। জল এবং হাওয়া জুড়ে রেখেছে গোটা দুনিয়াকেই। দূষণও এই জল এবং হাওয়ায় ভর করে হয়ে ওঠে সর্বজনীন।

এই সমস্যা থেকে মুক্তির পথ কোথায়? সম্প্রতি একটি জিগির উঠেছে— ভোগবাদে লাগাম টানার। উদ্দেশ্য সাধু হলেও পথটি মারাত্মক। বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি মানুষের ভোগবাসনা। সত্যিই যদি তাতে লাগাম টানা হয়, তা হলে ব্যাহত হবে উৎপাদনের প্রক্রিয়া, কোপ পড়বে বহু মানুষের কর্মসংস্থানে, স্থবির হবে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার গতি। তার কোন প্রভাব পরিবেশের উপরে পড়বে, সে হিসাব জটিল— কিন্তু, তাতে লাভের পাল্লা ভারী হবে কি না, তা নিয়ে বিস্তর সংশয় রয়েছে। অন্য দিকে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভাবনা ছাড়াই যদি ভোগবাদকে অব্যাহত রাখতে হয়, তা হলে শেষ অবধি বর্জ্যের ভারে চাপা পড়ে যাওয়ার বিপদও মারাত্মক। বাস্তববাদ তাই বলবে মধ্যপন্থা সন্ধান করার কথা। আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানও জোর দিচ্ছে সেই মধ্যপন্থার উপরেই— একটি চক্রাকার অর্থব্যবস্থা গঠন করার প্রস্তাব আলোচিত হচ্ছে, যেখানে ফেলা যাবে না কিছুই। যার একটি রূপ হল ‘জ়িরো ওয়েস্ট’ সমাজব্যবস্থা, যেখানে কিছুই বর্জ্যে পরিণত হবে না। প্লাস্টিকের মতো বস্তু, যা পচে যেতে সময় লাগে কয়েক হাজার বছর, তার পরিবর্তে পচনশীল উপাদান ব্যবহার করার কথা হচ্ছে। যে ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হচ্ছে সেই বস্তু রিসাইক্‌ল করার উপরে। ব্যক্তি অথবা পরিবার স্তরে বর্জ্য পৃথকীকরণের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা চলছে, যাতে বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন বা তাকে পুনর্ব্যবহার করা চলে; অথবা নিরাপদ বর্জ্যকে ব্যবহার করা চলে ল্যান্ডফিল হিসাবে। ধনতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে এই বিপদের সুষ্ঠু সমাধানসূত্র খুঁজে পেতেই হবে। এবং, সে দায়িত্ব কেবলমাত্র সরকারের হলে প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট কুশলী হবে না। বেসরকারি ক্ষেত্রকেও নিজেদের দায়িত্ব বুঝতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Waste Environment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy