E-Paper

জয়যাত্রা

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, জেমিমাদের কী আসে যায় সমাজের মনোভাবে? কেন দর্শকধন্য হতেই হবে তাঁদের— নিজেদের খেলাকে বিশ্বমানে নিয়ে যেতে পারাই কি যথেষ্ট নয়?

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫১
বিশ্বকাপ হাতে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল।

বিশ্বকাপ হাতে ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল। ছবি: পিটিআই।

নবী মুম্বইয়ের ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে যখন স্বপ্নের মধ্যরাত নেমে এল, ক্রিকেটের মহাতারকা থেকে সাধারণ দর্শক সবাই ভেসে গেলেন আবেগের উথালপাথাল স্রোতে, তখন হরমনপ্রীত-স্মৃতি-রিচা-শেফালি-দীপ্তি-জেমিমারা ঠিক কী প্রমাণ করলেন? এই যে, ভারতের মেয়েরা বিশ্বমানের ক্রিকেট খেলতে পারেন? অথবা, ভারতীয় মেয়েরা শিখে নিয়েছেন, কী ভাবে সর্বোচ্চ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফাইনালের চাপ সামলাতে হয়? প্রথম কথাটির প্রমাণ এই দলের অপেক্ষায় ছিল না— আট বছর আগে, ঝুলন গোস্বামী-মিতালি রাজের ভারত সে কথা গোটা দুনিয়াকে জানান দিয়েছিল। তাঁরা অবশ্য বিশ্বকাপের ফাইনালে হেরেছিলেন, এ বার হরমনপ্রীত-স্মৃতির ভারত জিতে দ্বিতীয় কথাটিও প্রমাণ করেছে। কিন্তু, তাঁদের আসল কৃতিত্ব অন্যত্র— দেড়শো কোটির ক্রিকেট-পাগল এই দেশকে তাঁরা বুঝিয়ে ছেড়েছেন, খেলার বিনোদনের লিঙ্গভেদ হয় না। ছেলেদের ক্রিকেট যতখানি আকর্ষণীয়, মেয়েদের ক্রিকেটও ঠিক ততটাই; ছেলেদের ক্রিকেট দর্শকের মনে আবেগের যে ঢেউ তোলে, মেয়েদের ক্রিকেটও ঠিক ততটাই পারে। এক আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই কথাটি এমন সপাটে প্রতিষ্ঠা করতে বিপুল সামর্থ্যের প্রয়োজন। ২০১১ সালে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সর্বময় কর্তা এন শ্রীনিবাসন বলেছিলেন, তাঁর একার হাতে থাকলে তিনি মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চালু হতেই দিতেন না। কারণ, ক্রিকেট খেলা মেয়েদের কাজ নয়। কথাটি তাঁর একার, বললে ভয়ঙ্কর ভুল হবে। সমাজের অনেকের কথা উচ্চারিত হয়েছিল তাঁর মুখে। সেই সমাজ, যার কোনও এক বীরপুঙ্গব এই ভারতীয় দলেরই অন্যতম এক খেলোয়াড়কে মাঠেই ধর্ষণ করার নিদান দেয়।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, জেমিমাদের কী আসে যায় সমাজের মনোভাবে? কেন দর্শকধন্য হতেই হবে তাঁদের— নিজেদের খেলাকে বিশ্বমানে নিয়ে যেতে পারাই কি যথেষ্ট নয়? একটি পাল্টা প্রশ্ন করা প্রয়োজন— ২০২৩ সালে কবাডিতে এশিয়াডজয়ী ভারতীয় পুরুষ দলের অধিনায়কের নাম জানেন ক’জন? অথবা, চক দে ইন্ডিয়া নামক অতি জনপ্রিয় ছবিটি নির্মিত হয়েছিল যে ভারতীয় হকি দলের ২০০২ সালের কমনওয়েলথ গেমস-এ স্বর্ণপদক জয়ের ঘটনার উপরে ভিত্তি করে, সূরজলতা দেবী যে সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন, সে কথা কত জনের মনে পড়বে? উত্তর অনুমান করা চলে। আন্তর্জাতিক সাফল্য সত্ত্বেও তাঁরা দর্শকধন্য হতে পারেননি, তাঁদের খেলার বাজার নেই বলে; এবং, তাঁরা দর্শকধন্য হননি বলে সেই বাজারও তৈরি হয়নি। মিতালি-ঝুলন থেকে শেফালি-রিচা-জেমিমাদের কৃতিত্ব, যে দেশ খেলা বলতে শুধু পুরুষদের ক্রিকেট বুঝত, তাঁরা সেই দেশকে রাত বারোটা অবধি জেগে থেকে মেয়েদের জয়কে উদ্‌যাপন করতে শিখিয়েছেন।

কাজটি কতখানি কঠিন ছিল, একটা তুলনা থেকে তার আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। ভারতের তিন সফলতম পেশা রাজনীতি, অভিনয়, এবং ক্রিকেটের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, তিনটি পেশাতেই পিতার উত্তরসূরি হিসাবে সন্তানরা এসেছেন। পুত্র এবং কন্যাসন্তান, উভয়েই। একমাত্র ব্যতিক্রম ক্রিকেট, যেখানে সফল পেশাদার ক্রিকেটার পিতার কন্যাসন্তান এই খেলায় এসেছেন, এমন উদাহরণ সম্ভবত একটিও নেই। আসেননি, তার কারণ, এই ক্ষেত্রটিতে যে মেয়েদের পক্ষে আদৌ সফল হওয়া সম্ভব, সে কথাই কেউ ভাবেননি। ভারতের মহিলা-ক্রিকেটারদের কৃতিত্ব, এই সাফল্য তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। এবং সেই কারণেই খুলে গিয়েছে একের পর এক দরজা— মেয়েদের প্রিমিয়ার লিগ চালু হয়েছে, পুরুষ-ক্রিকেটারদের সমান বেতন চালু হয়েছে। বাজারের জোর না থাকলে এগুলো হত কি? সেই বাজার তাঁরা অর্জন করেছেন নিজেদের জোরে। আশা করা যায়, ভারতে মহিলাদের ক্রিকেটকে আর কখনও ফিরে তাকাতে হবে না। সেই জয়যাত্রায় ২০২৫-এর ২ নভেম্বর একটি মাইলফলক হয়ে থাকল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Harmanpreet Kaur ICC Womens World Cup 2025 India Women Cricket team

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy