ফেসবুকের প্রাক্তন কর্মী সোফি ঝ্যাং তথ্যপ্রমাণ পেশ করে জানিয়েছেন, ভারতে ফেক অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাটি বিজেপির প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। অভিযোগটিতে অবশ্য চমকে ওঠার অবকাশ নেই। ভারতে বিজেপির প্রতি ফেসবুকের পক্ষপাতের বহু প্রমাণ আগেও মিলেছে— বিজেপি নেতাদের বিদ্বেষমূলক প্রচারে ফেসবুক সজ্ঞানে নিষ্ক্রিয় থাকছে, এই অভিযোগে তোলপাড় পড়েছিল ২০২০ সালে। কী ভাবে হিন্দুত্ববাদী মিথ্যা প্রচার ফেসবুকের প্রশ্রয় পেয়েছে, এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক অশান্তির ঘটনায় কী ভাবে বারংবার ফেসবুকের নাম জড়িয়েছে, সেই খতিয়ানও সহজলভ্য। অন্য দিকে, শুধু ভারতই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের (প্রধানত উগ্র দক্ষিণপন্থী) শাসকদের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। বস্তুত, সেই ঘটনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার ‘অপরাধ’-ই ফেসবুকে সোফির চাকরি খোয়ানোর কারণ। অর্থাৎ, ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে সোফি যে কথাগুলি বলেছেন, তা ভারতের ক্ষেত্রেও নতুন নয়, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতেও অতি পরিচিত। এবং, সেই জন্যই কথাগুলিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়— কারণ, তিনি যে উদাহরণগুলি দিয়েছেন, সেগুলি ব্যতিক্রমী নয়, বরং ফেসবুক নামক সংস্থাটির বৈশ্বিক ধরন। কেন এই পক্ষপাত, সেই কারণটি বিশ্লেষণ করা জরুরি।
ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মের রাজনৈতিক গুরুত্ব কতখানি, ২০১৪-উত্তর ভারতে সে কথা আর আলাদা ভাবে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। ‘নরেন্দ্র মোদী’ নামক অতিমানবীয় সত্তার নির্মাণ, অথবা আশি শতাংশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার দেশে ‘হিন্দুরা বিপন্ন’ নামক সম্পূর্ণ অলীক একটি ধারণাকে বহুজনবিশ্বাস্য করে তোলা— একবিংশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি প্রধান চালিকাশক্তি ফেসবুক। অন্য দিকে, ভারতের মতো বিপুল বাজারে নিজেদের উপস্থিতির প্রাবল্য ক্রমেই বাড়িয়ে চলতে হলে যে দেশের শাসকদের হাতে রাখতে হয়, এ কথা ফেসবুক জানে। শুধু ভারতের ক্ষেত্রেই নয়, কথাটি দুনিয়ার সর্বত্রই সত্য— বিশেষত যেখানে শাসকরা চরিত্রে মূলগত ভাবে একাধিপত্যকামী— শাসককে চটালে দেশের বাজারে টিকে থাকা মুশকিল। ফলে, গোটা দুনিয়াতেই দক্ষিণপন্থী শাসক ও ফেসবুকের মধ্যে এক আশ্চর্য মিথোজীবী বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। এবং, একই সঙ্গে এই কথাটিও মনে রাখা জরুরি যে, দক্ষিণপন্থীদের রাজনৈতিক বার্তা চরিত্রগত ভাবে অনেক বেশি আদিম আবেদনময়— কখনও তাতে জাতীয়তাবাদের গর্ব, কখনও সংখ্যালঘুর হাতে পর্যুদস্ত হওয়ার ভয়, কখনও চারটি বিয়ে করতে না পারার ঈর্ষা। তার তুলনায় বণ্টনের সাম্য অথবা ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা মানুষের কাছে পানসে ঠেকতে পারে।
কিন্তু, এই ‘সহজ কারণ’গুলি একটি বৃহত্তর প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের তুলনায় যে বাজারব্যবস্থা শ্রেয়, এ কথা অস্বীকার করার কোনও কারণ বা উপায় নেই। কিন্তু, কোনও অতিবৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি স্বেচ্ছায়— শাসকদের প্রসাদ অর্জনার্থে— রাষ্ট্রীয় শাসকদের অন্যায় হস্তক্ষেপের সামনে নতিস্বীকার করে, ফেসবুক যেমন করছে? অনুমান করা চলে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই বাজারটি যদি প্রকৃতার্থে প্রতিযোগিতার বাজার হত, যদি বেশ কয়েকটি সমান মাপের সংস্থা এই বাজারের দখলের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত, তা হলে শাসকদের সামনে মাথা নুইয়ে মুনাফা অর্জনের প্রবণতা এমন সর্বাত্মক হত না। কিন্তু, এই বাজারে অদূর ভবিষ্যতে তেমন প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অতএব, এক দিকে প্রয়োজন সংস্থার আত্মনিয়ন্ত্রণ; অন্য দিকে, রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে তোলা প্রয়োজন প্রকৃতার্থে স্বাধীন নজরদারি প্রতিষ্ঠান। বাজারের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, গোটা দুনিয়ার স্বার্থে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy