কোন বোধটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি তাড়না করে? এ প্রশ্নের উত্তর যুগে যুগে খুঁজে ফিরেছেন নানান মানুষ— বিজ্ঞানী, দার্শনিক, লেখক, শিল্পী, সমাজকর্মী। প্রত্যেকের এষণার পরিধিটি আলাদা; উপকরণ, মাপকাঠিও। কিন্তু যে জায়গাটিতে সবাই এসে মিলেছেন কখনও না কখনও, তা হল ক্ষুধা। মানুষের খিদে পায়: উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, পণ্ডিত-মূর্খ সব মানুষেরই; ক্ষুধাবোধই প্রকৃত সমভাবের চিহ্ন। তবে সমাজ-মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, বিশ্বের অনেক মানুষই ক্ষুধার বোধ কী তা বুঝতে পারেন না, কারণ চেতনে-অবচেতনে তাঁরা জানেন তাঁদের কাছে খাবার আছে, বা তা জোগাড়ের সামর্থ্য আছে। যাঁদের তা নেই, তাঁরাই জানেন ক্ষুধার বোধ, তার তাড়না। দার্শনিকেরা তাই বলেন, সভ্যতা সংস্কৃতি শিক্ষা ইত্যাদি পোশাকে নিজেকে ঢেকে রাখা মানুষ আসল মানুষ নয়, এক জন ক্ষুধার্ত মানুষই প্রকৃত মানব, ‘এসেনশিয়াল হিউম্যান’। ক্ষুধার তাড়না তাকে দিয়ে সব করাতে পারে— তার সব সঞ্চয় ও বৈভব সে ছাড়তে পারে, শারীরিক-মানসিক সম্ভ্রম এতটুকু ধরে না রেখে যার কাছে খাবার মিলবে তার সামনে নতজানু, কৃতাঞ্জলি হতে পারে।
তথাকথিত সভ্য মানুষ যে দিন এই সারসত্য বুঝেছে, সে দিন থেকেই ক্ষুধাকে করে তুলেছে অস্ত্র। সত্যিকারের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নিমেষে বিপক্ষের প্রাণ কাড়া যায়, বাকি জীবনের জন্য করে দেওয়া যায় জীবন্মৃত। কিন্তু সে বুঝেছে, ক্ষুধাও এমন এক শক্তিশালী অস্ত্র, যা প্রয়োগের ফল মেলে অনায়াসে। ইতিহাসের নানান যুদ্ধে তাই ক্ষুধা হয়ে উঠেছে ক্ষমতাধরের প্রিয় অস্ত্র। বিপক্ষের খাদ্যের রসদ ধ্বংস করে দিলে, খাবারের সরবরাহ-শৃঙ্খলটি মুছে দিলে শত্রু ক্ষুধার্ত ও নিস্তেজ হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবে— এই কৌশল। অতীতে গড়, কেল্লা, দুর্গ গড়ে শত্রু প্রতিরোধের ভাবনায় রক্ষণের পাশাপাশি তাই গুরুত্ব পেত সংরক্ষণও, শত্রু আক্রমণ করলে পরিখা ও বিরাট প্রাচীরে ঘেরা কেল্লার মধ্যেই রাজা ও প্রজা যাতে দীর্ঘকাল খেয়েপরে বাঁচতে পারেন তা নিশ্চিত করা হত। অধুনা প্রযুক্তির হাত ধরে যুদ্ধের চরিত্রটি আমূল বদলে গিয়েছে, বহুদূর থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে বা বোতাম টিপেই এখন শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র যতই সর্বাধুনিক ও ক্ষুরধার হোক, ক্ষুধাস্ত্র নিক্ষেপের ধারাটি কিন্তু আজও অব্যাহত। এই সময়ের দুই বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্র তার প্রমাণ— ইউক্রেন ও গাজ়া।
ক্ষুধাকে যে কতদূর পর্যন্ত যুদ্ধে কাজে লাগানো যায়, পৃথিবী তা দেখছে— বিশেষত গাজ়ার আয়নায়। ক্ষুধার প্রয়োগক্ষেত্রটি হল দুর্ভিক্ষ, গাজ়ায় সেই দুর্ভিক্ষ তৈরি করা হয়েছে অঙ্কের হিসাবে। হিসাবটি সহজ: প্যালেস্টাইনিরা যাতে গাজ়া ছাড়তে না পারেন, প্রথমেই তা নিশ্চিত করা। যুদ্ধ হলেই দলে দলে মানুষ দেশ ছাড়ে, এখানে সে পথ বন্ধ। স্বদেশে থাকতে হলে খেয়ে বাঁচতে হবে, কিন্তু স্থল ও আকাশ-যুদ্ধে ‘দেশ’ এরই মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত, কৃষিজমি নিশ্চিহ্ন। মাটি যখন বন্ধ্যা, তখন খাবারের সন্ধানে জলের কাছে যাওয়া যায়। তিন দিক স্থলবেষ্টিত গাজ়ার খোলা দিকটিতে যে ভূমধ্যসাগর, সেখানে মাছ ধরতে গিয়ে গাজ়াবাসী দেখছেন সেও নিষিদ্ধ, ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস সাঁতারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, সমুদ্রের ধারেকাছে প্যালেস্টাইনিদের দেখলেই গুলিবৃষ্টি। প্রতিবেশী মিশরের মানুষ বোতলের মধ্যে শুকনো খাবার, গুঁড়ো দুধ পুরে বোতল জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন, যদি তা পৌঁছয় গাজ়ার তটে— করুণ ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদমাধ্যমে। গাজ়াবাসীর খাবারের প্রতিটি ক্যালোরি এখন বাইরে থেকে এসে পৌঁছনোর উপর নির্ভরশীল। সেও অতিনিয়ন্ত্রিত: রাষ্ট্রপুঞ্জ, মানবাধিকার সংগঠন ও অন্য দেশগুলি থেকে আসা খাবার ও ওষুধ গাজ়ায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে নামমাত্র। ইজ়রায়েল জানে গাজ়ার বাসিন্দাদের ক্ষুধা নিবৃত্তিতে ঠিক কতটুকু খাবার দরকার, কতটুকু হাতে দিলে মানুষগুলো খিদে আর অসুখে ভুগে কঙ্কালসার হয়ে যাবে কিন্তু বেঁচেও থাকবে, একেবারে মরে যাবে না— ক্ষুধাকেন্দ্রিক এই ‘গবেষণা’ তারা করে আসছে আজ নয়, গত কয়েক দশক ধরে। যে ইজ়রায়েলি সংস্থাটি গাজ়ায় খাদ্য পরিবহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারা হিসাব করে দেখেছে যে প্যালেস্টাইনিদের মাথাপিছু রোজ গড়ে ২২৭৯ ক্যালোরি দরকার, ১.৮ কেজি খাবারের মধ্য দিয়ে যা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের থাবায় তার অর্ধাংশও অমিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেষ এমন ক্ষুধাবোধের তুলনা হতে পারে একমাত্র নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদি ও অন্য বন্দিদের খিদের সঙ্গে। অন্য ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে কি না জানা নেই, ক্ষুধার ইতিহাসধারাটি যুগ ও যুদ্ধ-নির্বিশেষে বহতা আজও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)