অপারেশন ‘রাইজ়িং লায়ন’: ইজ়রায়েলের ভয়াল আক্রমণ ইরানের উপর। আকস্মিক ঘূর্ণিপাকের মতো এই আক্রমণ আছড়ে পড়ল। আশঙ্কা, ধাপে ধাপে আক্রমণের পরিমাণ এবং বিপদের আয়তন উচ্চতর মাত্রায় যাবে। ইরানের পরমাণু কেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটির উপর এত বড় আক্রমণের পর, এবং ইরানের সামরিক প্রধান স্বয়ং নিহত হওয়ার পর, তেহরানও বিপুল পরিমাণ ড্রোনবাহিনী নিয়ে প্রত্যাঘাতে প্রস্তুত। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সি বা আইএইএ নিশ্চিত করেছে যে ইরানের নাতানজ় পরমাণুকেন্দ্র আক্রান্ত— যদিও সেখানে কোনও রেডিয়েশন বা পরমাণুবিকিরণের খবর এখনও নেই। ১৯৮০-র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর আর এত বড় আঘাত সে দেশকে সামলাতে হয়নি। ফলে এই পর্ব সহজে মিটবে বলে মনে হয় না— বিশ্বদুনিয়ার পক্ষে বিরাট দুঃসংবাদ।
দুর্দৈবে গ্রস্ত পৃথিবী। এক দিকে প্যালেস্টাইনের উপর ইজ়রায়েলের নিত্যনতুন আক্রমণ চলছেই, অন্য দিকে ইউক্রেন-রাশিয়া এখনও অস্ত্র সংবরণে অসম্মত, আর এক দিকে ভারত-পাকিস্তান সম্মুখসমরে আপাতত ঠেকা দেওয়া গিয়েছে। বাস্তবে অবশ্য এই সবকেই ছাপিয়ে যেতে পারে ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের ভয়াবহতা। তাই এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপুঞ্জ ও অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের উচিত, তেল আভিভ এবং তেহরানকে কোনও ক্রমে নিরস্ত করা, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে নিবৃত্ত করা। তবে যে-হেতু আমেরিকার অনবধানে ইজ়রায়েল এই পদক্ষেপ করেছে বলে মনে হয় না— আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা যে দাবিই করুন না কেন— ধরে নেওয়া যায়, তেল আভিভকে সংযত করার কোনও পথই আজ অবশিষ্ট নেই।
কেন এই হঠাৎ-আক্রমণ? তেল আভিভের গোয়েন্দা-সূত্র জানিয়েছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বহু আন্তর্জাতিক বাধা সত্ত্বেও সীমা অতিক্রম করে ‘পয়েন্ট-অব-নো-রিটার্ন’ স্পর্শ করেছে। এ কথা ঠিক, অনেক দিন ধরেই ইরানের এই পরমাণু কার্যক্রম ইজ়রায়েলের পক্ষে বিপজ্জনক বলে বিশ্লেষকরা জানিয়ে এসেছেন। ২০২৪ সালেও ইরানের পরমাণু ও মিসাইল কার্যক্রম নিয়ে দুই পক্ষে সামরিক আঘাত-প্রত্যাঘাত ঘটেছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার ফলে নেতানিয়াহু সরকার অনেক বেশি জোর পেয়েছে, এই অনুমান ভিত্তিহীন নয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, প্রথম ট্রাম্প-শাসনকালে ২০১৫ সালের আমেরিকা-ইরান পরমাণু চুক্তি বাতিল ঘোষিত হয়, এবং ইরানের উপর নির্দয় নিষেধাজ্ঞাসমূহ চাপানো হয়। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প প্রশাসন যদিও ইরানের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করার ইঙ্গিত দেয়, কিন্তু তাতে অত্যধিক বিলম্বের অবকাশেই বিষয়টি প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে দাঁড়িয়ে গেল। দায়িত্ব আমেরিকাকেও নিতে হবে বইকি, কেননা প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রকাশ্যেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, ইরানের পরমাণু অস্ত্র কেন্দ্রের কাণ্ডকারখানা বিষয়ে ওয়াশিংটন ইরানকে ‘কোণঠাসা’ করার জন্য। সমগ্র ঘটনা বুঝিয়ে দেয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য বলতে এখন কিছুই নেই। ট্রাম্পের আমেরিকা নাকি ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ থেকে বিরত হতে বাধ্য করেছে। এ দিকে সেই আমেরিকারই চোখের সামনে একের পর এক ভয়াবহ আক্রমণে পৃথিবীকে প্রত্যহ ভয়াবহ বিপন্নতায় ঠেলে দিচ্ছে ইজ়রায়েল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)