—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
এক নতুন লড়াইয়ের ইতিহাস তৈরি হয়ে উঠছে ভারতের একটি প্রান্তে। তার তাৎপর্য ঠিক কী প্রকার, সবটা স্পষ্ট না হলেও একটি অর্থ বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জম্মু ও কাশ্মীর অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়ে উঠবার পর এই প্রথম বার বিধানসভা ভোট হচ্ছে সেখানে, যার অর্থ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপের মাধ্যমে সে অঞ্চলের বিশেষ স্বীকৃতি রদের পর এই প্রথম ভোট। তিন পর্বে ভোটের দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর আজ নিশ্চিত ভাবেই বলা যেতে পারে, অনেক হতাশা, আশাভঙ্গ, আশঙ্কা, বিপদ, ক্লেশস্বীকার, অভাব-অভিযোগ, অধিকার-হনন, এ সব সত্ত্বেও এই নির্বাচনে যে কাশ্মীরের মানুষ আবার তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যবহার করে ভোট দিতে এগিয়ে এসেছেন, এ এক বিরাট সুসংবাদ। গত পাঁচ বছরে ৩৭০ ধারা লোপ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতির আড়াল দিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকার যে অপশাসন এখানে জারি রেখেছে, যে ভয়ঙ্কর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কাশ্মীরি সমাজ দিনাতিপাত করেছে, বাক্স্বাধীনতা, অবাধ চলাচল, ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা থেকে সন্ত্রাসে মদতের অভিযোগে প্রমাণ-ব্যতিরেকে যে কোনও তরুণতরুণীকে গ্রেফতার করা, কঠোর মামলায় ফাঁসানো— এই কাহিনি এখন বহুশ্রুত। কেবল ভারতে নয়, বিশ্ব জুড়ে তা আলোচিত, নিন্দিত। তবু এ বারের নির্বাচন দেখিয়ে দিল, সর্বপ্রকার নাগরিক স্বাধীনতার উপর্যুপরি দলনে ধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত সমাজের কাছ থেকেও কেমন সাড়া মিলতে পারে। গত লোকসভার চেয়েও বেশি ভোট পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সাড়া আসলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রতি আস্থা জ্ঞাপন। এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রক্রিয়াটিরই জয় সূচিত হল, আরও এক বার।
প্রধান দু’টি আঞ্চলিক দল আবদুল্লা পরিবারের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) এবং মুফতি পরিবারের নেতৃত্বে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)-র প্রতি জনসমর্থন কমছে, এবং অন্য প্রার্থীদের দিকে ঝুঁকছে, এমন একটি মত শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুতর, কেননা ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ দল জামায়াত-ই-ইসলামি’র বহু নেতা অন্য পরিচয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এক দিকে যেমন এর মধ্যে আছে আঞ্চলিক বনাম কেন্দ্রীয় রাজনীতির সংঘাত, অন্য দিকে আছে কাশ্মীর অস্মিতার একটি নতুন মঞ্চ খোঁজার তাড়না। এনসি এবং পিডিপি, দুই দলেরই জনপ্রিয়তা তলিয়েছে কেন্দ্রের সঙ্গে হাত মেলানোর সূত্রে। অতীতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ফারুক আবদুল্লা ও তাঁর পুত্র ওমর, এবং সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি-পিডিপি সরকার তৈরি করে নেত্রী মেহবুবা মুফতি দ্রুত বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন। অন্য দিকে বাড়ছে জামায়াতের প্রভাব, সংবাদ সূত্রানুযায়ী, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও ইসলামি চর্চাকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বিপুল আকার ধারণ করেছে তাদের কর্মকাণ্ড।
৩৭০-উত্তর যুগে যে কাশ্মীরে আঞ্চলিক আবেগ কতটা সবেগ ও সুগভীর, তার অনেক ইঙ্গিত মিলেছে গণপরিসরে। রাজনৈতিক পরিসরে তার প্রভাব বোঝা যাবে— যদি শেষ অবধি ভোট মুক্ত ও ন্যায্য পথে হয়। আঞ্চলিক দলগুলি তা বুঝে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, যেমন রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য চেষ্টা করা, তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের জন্য লড়া, দমনপীড়নের ব্যবহৃত পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট (পিএসএ) বাতিল করা, সন্ত্রাসে মদতের অভিযোগে শত শত সরকারি কর্মীর চাকরি যাওয়ার মোকাবিলা করা ইত্যাদি। কিন্তু সাধারণ পাঠকও জানেন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মোদী সরকারের দয়ার উপর নির্ভর করেই এই প্রতিশ্রুতি মেটানোর চেষ্টা করতে হবে, ফলে কাশ্মীরের মানুষ কতখানি তাঁদের পুরনো নেতাদের উপর ভরসা রাখতে পারবেন, বলা মুশকিল। হয়তো এক অন্য রাজনীতির পথ খুঁজতে হবে কাশ্মীরকে, গণতন্ত্রের উপর বিশ্বাস রেখেই। এই বারের নির্বাচন সেই পথের সূচনাবিন্দু হতে পারে কি না, ফলাফল দেখে তা ঠাহর করা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy