Advertisement
E-Paper

টাকা কোথায়

রাজ্যের সিংহভাগ বিধানসভা কেন্দ্রই মূলত গ্রামীণ, অতএব নেহাত পাটিগণিতের অঙ্কেই গ্রাম রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫৯
Share
Save

আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটটি যে ‘জনমু‌খী’ হবেই, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ ছিল না। এই বাজেটের ভরকেন্দ্র গ্রাম। রাজ্যের সিংহভাগ বিধানসভা কেন্দ্রই মূলত গ্রামীণ, অতএব নেহাত পাটিগণিতের অঙ্কেই গ্রাম রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে বর্তমানে তা আরও বেশি, কারণ শহরাঞ্চলের ভোটারদের একটা বড় অংশ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্ক মোটের উপরে অক্ষতই রয়েছে। অর্থনীতির যুক্তি অনুসারে এই খরচে আপত্তি করার কারণ নেই— গৃহনির্মাণের খাতে খরচ করলেও সে টাকায় কর্মসংস্থান হবে, টাকা ঘুরে বাজারে আসবে; লক্ষ্মীর ভান্ডারের খরচও শেষ অবধি বাজারের চাহিদাই বাড়াবে। গৃহ বা সড়ক নির্মাণের মতো প্রকল্পে স্থায়ী সম্পদও সৃষ্টি হবে। প্রশ্ন অন্যত্র। প্রথম কথা, এই বিপুল অর্থের সংস্থান হবে কোন পথে? সহজ উত্তর— ঋণের মাধ্যমে। কারণ, গত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে অনুমান পেশ করা হয়েছিল, বছর শেষের সংশোধিত হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, আদায়ের পরিমাণ তার তুলনায় কম। বর্তমান বাজেট রাজস্ব আদায়ের অনুমান গত বাজেটের অনুমানের চেয়েও অনেকখানি বেশি— ফলে, সে আশা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি, অনুমান করা চলে। এই অবস্থায় সরকার ভোটমুখী বিপুল ব্যয়ের পথে হাঁটলে তার ফল বিপজ্জনক হতে পারে।

সেই বিপদের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে ঋণের পরিমাণে। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে এই অনুপাত ছিল ৩৬.৮৮%; বাজেটে অনুমান, আগামী অর্থবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭.৯৮ শতাংশে। ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির জিএসডিপি-ঋণের অনুপাতের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এমনিতেই সঙ্গিন— তার উপরে সেই অনুপাত এক বছরের মধ্যে আরও ১.১ শতাংশ-বিন্দু বাড়লে তা দুঃসংবাদ। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের যে পাঁচটি রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক, পশ্চিমবঙ্গের নাম রয়েছে সেই তালিকায়। এই অবস্থায় রাজ্যের কোষাগার এই বিপুল ব্যয়ের বোঝা টানতে পারবে কি না, প্রশ্ন উঠবেই। তার চেয়েও উদ্বেগজনক কথা হল, যে সব খাতে বরাদ্দ বেড়েছে নামমাত্র, শিক্ষা তার মধ্যে একটি। পশ্চিমবঙ্গের বহু স্কুল-কলেজ পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে; নতুন তৈরি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেশির ভাগই আক্ষরিক অর্থে নামমাত্র— সেখানে শিক্ষকও নেই, পরিকাঠামোও নেই। কিন্তু, রাজনীতিকরা অভিজ্ঞতায় শিখে নিয়েছেন যে, শিক্ষা দিয়ে ভোট আসে না। ফলে, আশাকর্মীদের মোবাইল ফোন দিতে অথবা সরকারি চাকুরেদের মহার্ঘভাতা বাড়াতে রাজ্য সরকারের যতখানি আগ্রহ, শিক্ষাখাতে খরচ করতে আগ্রহ তার তুলনায় সামান্যই। মহিলা ও শিশুকল্যাণ খাতেও বৃদ্ধির কার্যত পুরোটাই গিয়েছে লক্ষ্মীর ভান্ডারে— যা দিয়ে ভোট পাওয়া যায়। যেখানে সরাসরি ভোট নেই, সেখানে বরাদ্দ বৃদ্ধিও নেই, এমনকি বহুলপ্রচারিত মহিলা উন্নয়নের প্রশ্নেও।

রাজ্যের বেসামাল অর্থনীতিকে আরও বেসামাল করেছে মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক জেদ। কেন্দ্রীয় সরকার একশো দিনের কাজ প্রকল্পে টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে বলে রাজ্য সরকারই সেই টাকা দেয়; কর্মশ্রী প্রকল্পে ৫০ দিনের কর্মসংস্থানও করে। কেন্দ্রীয় আবাস যোজনার প্রতিস্পর্ধী বাংলার বাড়ি প্রকল্প চালায়। এই বাজেটে কেন্দ্রীয় গ্রাম সড়ক যোজনার সঙ্গে টক্কর দিতে সড়ক নির্মাণেও রাজ্য সরকার হাত খুলে বরাদ্দ করেছে। এই জেদের রাজনৈতিক মাহাত্ম্য কতখানি, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই সে হিসাব কষে নিয়েছেন। তবে, যে রাজ্যের কাঁধে ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে, তার পক্ষে এতখানি জেদের ধকল সহ্য করা কঠিন। কেন্দ্রের সঙ্গে আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারা যে একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা, সেই সত্যটিও কিন্তু ঢাকা যাচ্ছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Budget West Bengal government

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}