Advertisement
১৫ অক্টোবর ২০২৪
R G Kar Hospital Incident

ঊন-নাগরিক?

উপলক্ষে অগণিত মেয়েদের যে ভাবে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে দেখা গিয়েছে, তা কি এমন দাসখত-লিখে-দেওয়া মানসিকতাকে প্রমাণ করে?

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৪৩
Share: Save:

বারে বারেই এই রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসর জুড়ে শোনা যাচ্ছে একটি প্রচার: মহিলারা যত দিন না লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর ১০০০ টাকার ‘লোভ’ ছাড়তে পারছেন, তত দিন অবধি নাকি তাঁদের নিরাপত্তার কোনও নিশ্চয়তা থাকবে না, কারণ তাঁদের নিরাপত্তা ও অন্য সমস্ত অধিকারের দাবিদাওয়া ওই টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া হয়েছে। প্রচারকদের মতে, লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা নেওয়ার অর্থ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা; সেই আনুগত্য থাকলে বর্তমান শাসনহীনতার প্রতিবাদ করা যাবে না, ফলে নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে না। প্রচারের আপাত-রাজনীতির উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট: আর জি কর-কাণ্ডে তৈরি হওয়া জন-অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস-বিরোধিতাকে মজবুততর করা। কিন্তু এই প্রচার একই সঙ্গে অযুক্তি এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করছে। প্রথমত, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর অনুগামীরা বিভিন্ন ভাবে এই প্রচারই করে থাকেন যে, তাঁরা ক্ষমতায় না থাকলে লক্ষ্মীর ভান্ডার ও অন্যান্য সাহায্যের প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে। এখন বিরোধীদের প্রচারও কার্যত তাঁদের কথাকেই মান্যতা দিচ্ছে না কি? দ্বিতীয়ত, যাঁরা সরকারি অর্থসাহায্য পাচ্ছেন, তাঁরা সেই প্রাপ্তির বিনিময়ে শাসকের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য দেখাচ্ছেন এবং দেখাবেন, এই ধারণা কোন নির্বোধ আকাশ থেকে বিরোধী প্রচারকদের মস্তিষ্কে এসে পড়ল? সাম্প্রতিক কালে, সন্দেশখালি থেকে আর জি কর অবধি নানা উপলক্ষে অগণিত মেয়েদের যে ভাবে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে দেখা গিয়েছে, তা কি এমন দাসখত-লিখে-দেওয়া মানসিকতাকে প্রমাণ করে?

লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি তৃণমূল কংগ্রেসকে যে রাজনৈতিক পুঁজি জুগিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অনুমান, সেই সূত্রটি বিচ্ছিন্ন করার তাড়নায় বিরোধীরা প্রকল্পটিকে ঢাকিসমেত বিসর্জনে আগ্রহী। লক্ষ্মীর ভান্ডারের কৃতিত্বটি থেকে তৃণমূলকে বিচ্ছিন্ন করতে চাওয়ার বদলে তাঁরা প্রকল্পটিকেই তুলে দিতে চান। রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির ঘাটতি তাঁদের বুঝতে দেয়নি যে, এটি কোনও দলের প্রকল্প নয়, তার টাকাও আসে রাজকোষ থেকে— ফলে প্রকল্পের উপরে অধিকারও কোনও দলের নয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে এমন নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের গুরুত্ব অর্থশাস্ত্রীরা বারে বারেই চিহ্নিত করেছেন। ফলে, এই প্রকল্পের গুরুত্ব স্বীকার করা বিরোধীদের প্রথম কর্তব্য ছিল। বস্তুত, এই আর্থিক সাহায্যের মধ্যে নিহিত সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারকে— অধিকার হিসাবে— নিশ্চিত করা সব দলেরই কর্তব্য। নাগরিক অধিকারের এই প্রশ্নটি স্বীকার না করে বিরোধীরা যে বার্তাটি দিয়ে থাকেন এবং দিচ্ছেন, তা হল— উন্নয়নের অধিকার বিষয়ে তাঁদের কোনও আগ্রহ নেই, তাঁরা ক্ষুদ্র রাজনীতির বাইরে ভাবতে নারাজ। প্রকল্পটির অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও রাজনৈতিক সম্ভাবনা তাঁরা আদৌ বোঝেননি। দৃশ্যত, তাঁদের কাছে এই প্রকল্পটি রাজনীতির আয়ুধ বই কিছু নয়।

লক্ষ্মীর ভান্ডারকে ‘ভিক্ষা’ বলার ভুলটির পুনরাবৃত্তি বুঝিয়ে দেয় যে, মানসিকতা সহজে পাল্টায় না। নিরাপত্তার দাবি করলে মেয়েদের হাজার টাকা ছাড়তে হবে, এ কথার মধ্যে তাঁদের প্রতি যে অসম্মান আছে, তা অতি দুর্ভাগ্যজনক। বস্তুত, এই মানসিকতার এক বিশেষ শ্রেণি ও লিঙ্গচরিত্র রয়েছে। যে-হেতু ধরে নেওয়া হয় যে, লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রাপকরা আর্থিক ভাবে তুলনায় দুর্বল, ফলে যাঁরা ‘উপর থেকে দেখছেন’, তাঁদের চোখে এই প্রাপকরা যেন ঊন-নাগরিক, রাষ্ট্রের কৃপাপ্রার্থী— ফলে, রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে দাবি করার সাধ্য তাঁদের নেই। অন্য দিকে, এই প্রাপ্তিটি যে-হেতু শুধুমাত্র নারীর, ফলে তাতেও পুরুষতন্ত্রের চোখ টাটায়। লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রাপকদের দিকে যাঁরা আঙুল তুলছেন, তাঁরা আসলে এক বিত্তশালী পুরুষতান্ত্রিক অবস্থান থেকে অন্যদের দেখছেন— সে দেখায় সম্মান নেই, শিষ্টতা নেই, সমতাও নেই। তাঁদের দাবিতে গলা মেলানোর আগে এই সত্যটি সম্বন্ধে অবহিত হওয়া জরুরি।

অন্য বিষয়গুলি:

Laxmi Bhandar Scheme
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE