পহেলগামে নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং তৎপরবর্তী ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের পর দিল্লির সামনে অন্যতম উদ্বেগ: তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোয়ান স্পষ্টাক্ষরে পাকিস্তানের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। ফলত, ভারতের রাজনীতি ও সমাজ, দুই মঞ্চেই এখন তুরস্ক-বিরোধিতার ঢেউ, নানাবিধ বয়কট ডাকের লক্ষ্য তুরস্ক। ব্যবসায়ীরা তুরস্ক থেকে তাঁদের সামগ্রী প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন, তুর্কি খাদ্যদ্রব্য রফতানি থেকে বিরত হয়েছে অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রোডাক্টস ডিস্ট্রিবিউটর্স ফেডারেশন। ভারতীয় পর্যটকরাও না কি দলে দলে তুর্কি দেশ ভ্রমণ বন্ধ করে দিচ্ছেন। এই সব পদক্ষেপ অনেকাংশেই তাৎক্ষণিক, যুক্তির থেকে আবেগেই বেশি আচ্ছন্ন। কোনও রাষ্ট্রের কূটনৈতিক অবস্থান অনেক সময়েই দীর্ঘমেয়াদি হয় না, বিশেষত যে রাষ্ট্র দীর্ঘ সময় নিরপেক্ষ বা বন্ধুসুলভ থেকেছে। ফলে রাজনৈতিক প্রণোদনায় সাময়িক উত্তেজনা তৈরির থেকে জরুরি হল বিবেচনা করে দেখা ভারতের কূটনৈতিক বলয়টিতে তুর্কিয়ে দেশটির গুরুত্ব কতখানি, এবং ভারতের স্বার্থের পক্ষে কোন পদক্ষেপ সুফলদায়ী হতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর্ডোয়ানের অধীনে তুরস্কে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জেরে কিছু কাল ধরেই ভারতের সঙ্গে সে দেশের সম্পর্কে টান পড়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের গরিমার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্যান-ইসলামিজ়ম’এর শক্তিশালী প্রবক্তা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন এর্ডোয়ান। এই মতাদর্শগত পুনর্বিন্যাসের ফলেই সম্প্রতি তুরস্কের বিদেশনীতি কিয়দংশে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছিল। ভূ-রাজনৈতিক ভাবেও, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির (ইউএই) নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় আরব প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তুরস্ক সৌদি-আমিরশাহির প্রভাব রোধের জন্য পাকিস্তানের মতো অ-উপসাগরীয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সহযোগিতার বিকল্প খুঁজছিল। তবে, এতৎসত্ত্বেও, আধুনিক তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বিনিময়— মোটের উপর ভারতের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কটি সৌহার্দেরই থেকেছে। এমনকি ২০২৩ সালেও সে দেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরে ‘অপারেশন দোস্ত’-এর মাধ্যমে এগিয়ে আসা প্রথম দেশগুলির অন্যতম ছিল ভারত।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন, কেন হঠাৎ তুর্কিয়ে এতখানি ভারতবিরোধী অবস্থান নিল। উত্তরটি সম্ভবত লুকিয়ে আছে এর্ডোয়ানের সাম্প্রতিক দক্ষিণ এশিয়া কূটনীতিতে। যে কোনও সামরিক উত্তেজনাবৃদ্ধিতে তুরস্কের ঘোর আপত্তি। ভারতের মাটিতে সন্ত্রাস তুর্কিয়ের চোখে সন্ত্রাস-মাত্র, কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযান— সামরিক আগ্রাসন। অনেকে বলতেই পারেন, যে কোনও পাকিস্তানপন্থী অবস্থানই আসলে ভারতের সঙ্গে ঘোর শত্রুতা। তবে এই সাদাকালো বিশ্ববীক্ষার উপরে উঠে কূটনৈতিক বিশ্বকে দেখা দরকার। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও আরও কিছু ভিন্ন দর্শনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি চলতে পারে। তাদের সঙ্গে জলচল বন্ধ করার বদলে দিল্লিকে বরং কৌশলী পদক্ষেপ করতে হবে। চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুরস্কও এখন ভারতের নিরাপত্তা পরিস্থিতিটিকে জটিল করে তুলেছে, কিন্তু সেই জটিলতার আবহে কূটবিবেচনা হারালে সর্বনাশ বাড়বে বই কমবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)