অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের পক্ষে যে যুদ্ধ বস্তুটি খারাপ, তা নিয়ে সংশয়ের তিলমাত্র নেই। একটি হিসাব বলছে, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চললে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে ১.৫ থেকে ৩ শতাংশ অবধি। অর্থাৎ, ২০২৫ সালে ভারতের জিডিপি ৩৬০ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়াবে বলেই অনুমান। অর্থাৎ, যুদ্ধের ফলে ভারতের জিডিপির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকায়। পরিমাণটি কতখানি, দু’-একটা তুলনা করলে বোঝা সহজ হবে— অঙ্কটি এই বাজেটে ভারতে মূলধনি খাতে মোট ব্যয়বরাদ্দ ১১.২১ লক্ষ কোটি টাকার প্রায় সমান; এবং পাকিস্তানের সমগ্র বাজেটের প্রায় পৌনে দু’গুণ। কাজেই, যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপকার হয়। পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থার চেহারা এমনিতেই যা হাল, যুদ্ধের খাঁড়ার ঘায়ে তার আর কী বা ইতরবিশেষ হবে! বরং, এই যুদ্ধ সে দেশের কার্যত শাসক সেনাবাহিনীর হাত শক্ত করতে পারে। কিন্তু, ভারতের অবস্থা আলাদা— বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধির হারসম্পন্ন বৃহৎ অর্থব্যবস্থার পথে এই অযথা যুদ্ধ যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করা অবশ্যই জরুরি।
যুদ্ধ করতে হলে তার খরচ তো আছে, কিন্তু তা মোট আর্থিক ক্ষতির একটি অংশমাত্র। যুদ্ধের অন্যান্য আর্থিক ক্ষতির তালিকা দীর্ঘ। যদি মানবসম্পদ বা রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ক্ষতির মতো জিনিসগুলিকে হিসাবের বাইরেও রাখা যায়, তবে যুদ্ধের অন্যতম ক্ষতি হল, প্রতিপক্ষ দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। পাকিস্তানের সঙ্গে সে ক্ষতি অকিঞ্চিৎকর, কারণ সে দেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ বাণিজ্য নামমাত্রই। কিন্তু, সেটিই একমাত্র ক্ষতি নয়। কয়েকটি ক্ষতি স্বল্পমেয়াদেই স্পষ্ট। ভারতগামী বিমানের জন্য পাকিস্তানের আকাশপথ বন্ধ হওয়ায় ইউরোপ এবং উত্তর এশিয়া থেকে আসা বহু বিমানকে ঘুরপথ ধরতে হয়েছে। তাতে বিমানযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। অন্য দিকে, এই ক’দিনের সংঘাতেই প্রবল প্রভাব পড়েছে পর্যটন ক্ষেত্রের উপরে। গত অর্থবর্ষে জিডিপিতে এই ক্ষেত্রটির প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ১৬ লক্ষ কোটি টাকা। ক্ষেত্রটিতে বিপুল কর্মসংস্থানও হয়। আবার, পাকিস্তানের নিকটবর্তী ভারতের পশ্চিম প্রান্তের বন্দরগুলিতে হানার সম্ভাবনা বাড়বে, সেই আশঙ্কায় বেড়ে যেতে পারে এই পথে পণ্যবাহী জাহাজের বিমার খরচ, যা শেষ অবধি অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি ঘটাবে। গত কয়েক সপ্তাহে আরও একটি কথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে ভারতের বন্ধুর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ফলে, যুদ্ধের আবহে বাণিজ্য-কূটনীতির হাওয়া ভারতের অনুকূলে বইবেই, তেমন ভরসা নেই। যেমন, জ্বালানির প্রশ্নে ভারত বহুলাংশে পশ্চিম এশিয়ার উপরে নির্ভরশীল। যুদ্ধের আবহে অন্তত স্বল্পমেয়াদে ভারতের পেট্রলিয়াম আমদানি খর্ব হতে পারে, সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আরও বড় দু’টি ক্ষতি আছে। প্রথমত, বৈশ্বিক পুঁজি রাজনৈতিক ও সামরিক অস্থিরতাকে ডরায়— ফলে, যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলেই পুঁজি দেশ ছাড়তে থাকে। এবং, পরিস্থিতি তুলনায় স্বাভাবিক হলে শেয়ার বাজারে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি যত দ্রুত ফেরত আসে, প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সময়কালটি তত কম নয়। ফলে, ভারতের মতো দেশে যুদ্ধের আবহ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন শ্লথতা তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষতিটি হল, যুদ্ধবিরতি যদি বা স্থায়ী হয়, যে কোনও মুহূর্তে তা ভঙ্গ হওয়ার সম্ভাবনা কখনও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ, সামরিক প্রস্তুতি জোরদার রাখতেই হয়। তাতে বিপুল টাকা প্রয়োজন। বাজেটের যে-হেতু স্বাভাবিক ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে, ফলে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াতে গেলে অন্য খাতে টান পড়বেই। এবং, তাতে প্রত্যক্ষ ক্ষতি উন্নয়নের। কাজেই, যুদ্ধের জিগির থেকে সাবধান থাকা প্রয়োজন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)