মহামান্য আদালত জানিয়েছে, ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে, এমন যে কেউ আধার কার্ডের ভিত্তিতে আদালতে আবেদন করতে পারেন হৃত ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে এটি এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ অস্ত্র। কিন্তু, তার প্রয়োগ সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ— বিশেষত, গরিব মানুষের পক্ষে। কাজেই আশঙ্কা হয়, আদালতের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও হয়তো বহু নাগরিক হারাবেন নাগরিক হিসাবে তাঁদের মৌলিকতম অধিকারটি— ভোট দানের অধিকার। প্রশাসন যে নাগরিকের পাশে নেই, এবং আদালত প্রদত্ত সমাধান যাঁর নাগালের বাইরে, তাঁর ভরসা হতে পারে রাজনীতিই। সদর্থক বিরোধী রাজনীতি। যে রাজনীতি এক দিকে বিপন্ন নাগরিককে ভরসা দেবে যে, এই লড়াইয়ে তিনি একা নন; এবং অন্য দিকে বিচ্ছিন্ন বিপন্ন মানুষকে এক সূত্রে সংগঠিত করবে। শাসক যাতে নাগরিকের অধিকার বিপন্ন না করতে পারে, তা নিশ্চিত করা বিরোধী রাজনীতির কর্তব্য।
বিহারে শুরু হওয়া ‘ভোটার-অধিকার যাত্রা’কে দেখা প্রয়োজন এই পরিপ্রেক্ষিতেই। রাহুল গান্ধী এবং তেজস্বী যাদবের মাথায় নিশ্চয়ই ভোটের হিসাব রয়েছে— নির্বাচনী গণতন্ত্রে তা থাকাই স্বাভাবিক— কিন্তু, যে যাত্রাটি তাঁরা আরম্ভ করেছেন, তাকে শুধুমাত্র ভোটের হিসাবের নিরিখেই দেখা চলে না। অন্তত তাঁদের যাত্রাপথে যে ভাবে সাধারণ মানুষের ঢল নেমেছে, তাতে বোঝা চলে, মানুষ তাঁদের দেখছেন আঁকড়ে ধরার খড়কুটো হিসাবে। ভরসা হিসাবে। রাষ্ট্র যাঁদের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে কার্যত অনাগরিক বানাতে চায়, তাঁরা সেই রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করার ঢাল হিসাবে দেখছেন বিরোধী রাজনীতিকেই। অকারণে নয়। ভোটার-অধিকার যাত্রার ঘটনাটিই মানুষকে জানিয়েছে, ঠান্ডা ঘরে বসে সমাজমাধ্যমসর্বস্ব রাজনীতি নয়, বিরোধীরা পথের ধুলোয় নামতে প্রস্তুত। শাসক পক্ষের তরফে স্বৈরাচারের পদধ্বনি যখন স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, তখন বিরোধী রাজনীতির পথে নামার তৎপরতা সাধারণ মানুষের পক্ষেও স্বস্তিদায়ক, সামগ্রিক ভাবে গণতন্ত্রের পক্ষেও। লক্ষণীয় যে, বিহারে বিরোধী নেতারা, বিশেষত তেজস্বী যাদব, প্রশ্নটিকে শুধু ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়ার মধ্যেই আটকে রাখেননি— রাষ্ট্র কাউকে কার্যত ‘অনাগরিক’ হিসাবে চিহ্নিত করে দিলে অন্যান্য মৌলিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও যে সমস্যাগুলি হয়, সে প্রসঙ্গে এসেছেন। বিরোধীদের লড়াই যে শুধু মানুষের ভোটাধিকার রক্ষার নয়, গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের প্রাপ্য সব অধিকারকে রক্ষা করার, তা স্পষ্ট ভাবে বলা দরকার।
এ ক্ষেত্রে বিরোধীদের আরও একটি বড় দায়িত্ব আছে— তাঁরা যে নেহাত মরসুমি পাখি নন, ভোটের ঋতু পেরোলেও যে তাঁরা মানুষের পাশে থাকবেন, এই বিশ্বাসটি জনমানসে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে এই ধারাবাহিকতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বিলক্ষণ। কিন্তু, পাশাপাশি এ কথাটিও স্মর্তব্য যে, বিহারে কংগ্রেসের অস্তিত্ব দীর্ঘ দিন ধরেই নামমাত্র হওয়া সত্ত্বেও রাহুল সে রাজ্যের ২০টি জেলায় ১৬ দিনের যাত্রায় নেমেছেন। এটি সম্ভবত বিরোধী রাজনীতির একটি বিস্মৃত, বিকল্প পন্থার ইঙ্গিতবাহী— যে রাজনীতির কেন্দ্রে থাকে সাধারণ মানুষের স্বার্থ। বস্তুত, এর আগে রাহুলের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ এবং ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ও ভারতীয় রাজনীতির ক্রমসঙ্কীর্ণ পরিসরে তৈরি করতে পেরেছিল এই বিকল্প সম্ভাবনাটি। প্রশ্ন অবশ্য রাহুল গান্ধী বা অন্য কোনও ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে নয়— প্রশ্ন হল, ভারতীয় রাজনীতির বিরোধী পক্ষ কি সাধারণ মানুষের পাশে থাকার গণতান্ত্রিক কর্তব্যটিকে ধারাবাহিক ভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত? এমনকি, যে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ, সেখানেও কি বিরোধীরা দীর্ঘ পথ হাঁটতে রাজি? তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষের ভরসা অর্জনের কাজটি কঠিন— সেই ভরসা টিকিয়ে রাখার কাজটি কঠিনতর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)