যে সময়টা শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখার, শরীরের পাশাপাশি মনের জগতেও নানা ভাঙচুর, স্পর্শকাতরতার, এবং পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখতে, চিনতে শেখার, ঠিক সেই অমূল্য সন্ধিক্ষণে চোদ্দো বছরের কৃষ্ণেন্দু দাস পৃথিবী থেকে সরে গেল অসহ্য অপমান আর অভিমানের বোঝা সঙ্গে নিয়ে। যা সে করেনি, সেই না-করার দায় জবরদস্তি তার উপর চাপানো হয়েছিল। এবং অতি নিকটজনও তার কথা সে দিন বিশ্বাস করেনি। চিপসের প্যাকেট ‘চুরি’র অপবাদে সর্বসমক্ষে মারধর, হেনস্থার ধাক্কা কিশোরমন সহ্য করতে পারেনি। আগাছানাশক পান করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। তার যে কথা কেউ শুনতে চায়নি, মৃত্যুর আগে সেই কথাগুলিই সে স্পষ্টাক্ষরে লিখে গিয়েছে— মা, আমি চুরি করিনি। সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। চিপসের প্যাকেট সে সত্যিই কুড়িয়ে পেয়েছিল— সিসিটিভি ফুটেজে তা প্রমাণিত। কিন্তু তার ক্ষতে প্রলেপ পড়ার সুযোগ মেলেনি। তার আগেই ছেলেটির সম্মানবোধ, আত্মরক্ষার আড়ালটুকু কেড়ে তাকে খুন করেছে— এই সমাজ।
এই অপরাধ লুকানোর জায়গা নেই। প্রতিনিয়ত চুরি, দুর্নীতি, প্রাপ্তবয়স্কদের ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথনের বোঝা বইতে গিয়ে এ সমাজ অপরাধবোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। একই সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছে যুক্তি, বুদ্ধি, ভাবনাচিন্তার সহজাত ক্ষমতাগুলিকেও। না হলে কিশোরকে যখন অভিযুক্ত করার প্রক্রিয়াটি চলছে, তখন কেউ প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন না কেন? ঘটনার দিন এক বারও স্পষ্ট ভাষায় কেউ যদি চুরির প্রমাণ দেখতে চেয়ে কিশোরের সমর্থনে এসে দাঁড়াতেন, তা হলে হয়তো এমন মর্মান্তিক পরিণতি হত না। কেউ আসেননি, কেননা জনমত সচরাচর দুর্বলের পাশে দাঁড়াতে পছন্দ করে না। পকেটমার, চোর সন্দেহে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনাগুলিতেই তা স্পষ্ট। তদুপরি, যে সমাজ অনিয়মকেই নিয়ম হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত, তার নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা ক্রমশ অকেজো হতে থাকে। সেই চুরি-দুর্নীতির চাপে যখন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সোজা পথগুলি অবরুদ্ধ হয়ে যায়, তখন সে হয় পারিপার্শ্বিকতার বোধ হারিয়ে নির্বাক থাকে, নয়তো অপেক্ষাকৃত দুর্বলকেই তার ক্ষোভ, রাগ উগরে দেওয়ার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নেয়। কৃষ্ণেন্দুর ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে।
উদ্বেগ তৈরি হয়— তুচ্ছ কারণে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ খোঁজার প্রবণতাটি দেখে। যে সমস্যা সামান্য কথায়, আলোচনায় মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব, তাকে এক অ-সম্ভব পর্যায়ে টেনে নিয়ে যাওয়া, এই সমাজের বিকৃতি। বলা বাহুল্য, রাজনীতি তাকে পদে পদে প্রশ্রয় দিয়ে চলে। প্রতিনিয়ত নেতারা তাঁদের কথায়, কাজে হিংসাপ্রবৃত্তির পরিচয় দেন, সামান্য বিরুদ্ধস্বর দেখলেই ব্যঙ্গে-বিদ্রুপে বা হুমকিতে তাকে পিষে মারতে চান। কৃষ্ণেন্দুর উপর নির্যাতন কিংবা সম্প্রতি নিউ টাউনে নিজের গাছ থেকে আম পাড়তে গিয়ে নিজেরই নিকটাত্মীয়দের মারে যুবকের মৃত্যু— এই মারমুখী অসহিষ্ণু হিংস্র মনস্তত্ত্ব যে একুশ শতকের তৃতীয় দশকেও এমন বহুব্যাপী, এর মূল কারণটিই নিহিত— শাস্তিহীনতার নিশ্চিন্তির মধ্যে। উপর থেকে নীচ, সর্বত্রই যদি বিকৃত সমাজমানস সুপ্রতিষ্ঠা পায়, তা হলে হিংস্রতার এই নিশ্চিন্ত অবকাশই একমাত্র ভবিতব্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)