কখনও কখনও যা ঘটে তার থেকে বেশি গুরুত্ব পায় কী ঘটেনি। কানাডায় সাম্প্রতিক জি৭ সম্মেলন সাক্ষী রইল তেমনই পরিস্থিতির। লক্ষণীয়, বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অর্থনৈতিক গোষ্ঠী ‘জি৭’কে তাদের সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে অনেক বেশি সুসংহত ও অভিজ্ঞ বলে মনে হওয়া উচিত ছিল। পরিবর্তে, ক্রমবর্ধমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইজ়রায়েল-ইরান সংঘর্ষ এবং গাজ়ায় ইজ়রায়েল-এর অবিরাম বোমাবর্ষণের মুখে একটি বিচ্ছিন্ন ও অকার্যকর শক্তি হিসাবে উপস্থাপিত হল গোষ্ঠীটি। সম্মেলনে একটি যৌথ বিবৃতির অনুপস্থিতি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির নেতাদের মধ্যে গভীরতর নীতিগত বিভাজনের চিত্রটিই আরও স্পষ্ট করে দিল। ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি ইতিমধ্যেই আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত ইউরোপীয়, কানাডিয়ান এবং জাপানি ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে। সেই ভাঙন আরও প্রকট হয়ে উঠল সম্মেলনে। অন্য দিকে, ইউক্রেন-সঙ্কটের প্রেক্ষিতে রাশিয়ার প্রতি, এবং সাধারণ ভাবে চিনের প্রতি ট্রাম্পের আপাত-নমনীয়মনোভাব নজর কেড়েছে অনেকেরই। বস্তুত, রাশিয়া ও চিনকে জি৭ গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করে জি৮ বা জি৯ বানানোর ট্রাম্পীয় পরামর্শ শুধু বাকি রাষ্ট্রনেতাদেরই নয়, হতাশা বাড়িয়েছে সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কিরও। ইজ়রায়েল-এর আগ্রাসনকে সক্রিয় ভাবে সমর্থন করার জেরে জি৭-এর একটি যুদ্ধবিরোধী খসড়া বিবৃতিও স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে আমেরিকা। বরং ইরানের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বিবৃতি প্রকাশেই বেশি চাপ দেয় আমেরিকা। তবে সম্মেলন থেকে ট্রাম্পের আগেভাগে প্রস্থান আগামী দিনে এই গোষ্ঠীর প্রাসঙ্গিকতার উপরেও প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে।
এ দিকে, শেষ মুহূর্তে কানাডার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সেখানে ‘নিমন্ত্রণরক্ষা’ করতে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সম্মেলনের আউটরিচ অধিবেশনে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে আন্তর্জাতিক দ্বিচারিতার নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় কোনও ‘দু’মুখো নীতি’-র স্থান নেই। প্রশ্ন তোলেন, যারা সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের কি একই মাপকাঠিতে ফেলা যায়? অধিবেশনে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশবান্ধব শক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ নিয়েও আলোচনা হয়। শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী হরদীপ সিংহ নিজ্জরের হত্যার অভিযোগের জেরে গত দু’বছর ধরে অটোয়া-র সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী কার্নির সঙ্গে সাক্ষাতে তা প্রশমনেরও সুযোগ মেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর। পূর্বে বিবাদের কারণে কূটনীতিবিদদের বহিষ্কার করার পরে একে অপরের রাজধানীতে পুনরায় হাই কমিশনার নিয়োগে সম্মত হয়েছে ভারত ও কানাডা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর ফোনালাপ। বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীর মতে, গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের পরে দুই তরফে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার যে দাবি ট্রাম্প বারংবার করে এসেছেন, মোদী তা স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতের ইঙ্গিত পরিষ্কার— তারা অতীতেও মধ্যস্থতা গ্রহণ করেনি, বর্তমানেও নয়, ভবিষ্যতেও করবে না। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এখানে কতটা লাভ হল, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে, তবে নিঃসন্দেহে সুবর্ণজয়ন্তীতে গোষ্ঠীবিভাজনের সাক্ষী হয়ে রইল ক্যানানস্কিস।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)