রবীন্দ্রনাথকে বারংবার স্মরণ করা বাঙালির একটি কু-অভ্যাস। সেই অভ্যাসেই আবারও তাঁকে উদ্ধৃত করা যাক: “বাস্তবতা-বিবর্জিত হইলে আমাদের মনই বল, হৃদয়ই বল, কল্পনাই বল, কৃশ ও বিকৃত হইয়া যায়। আমাদের দেশহিতৈষা ইহার প্রমাণ।” ১৯০৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’-এ তাঁর এই উক্তি আবারও পাঠকের চিত্তপটে দাগ কেটে যেতে পারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক রামনাথ গোয়েঙ্কা স্মারক বক্তৃতা শুনে, যেখানে তিনি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে-কে ও তাঁর সূত্রে ‘ইংরেজি শিক্ষার গোলাম’ ভারতবাসীকে তীব্র আক্রমণ করেছেন। বলেছেন ‘মেকলে মানসিকতা’ সম্বলিত ইংরেজি-শিক্ষিতদের কবল থেকে ‘প্রকৃত’ ভারতকে উদ্ধার করা দরকার, বিলেত থেকে আমদানিকৃত ধ্যানধারণা ও কাজকর্ম পরিহার করে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে ফেরা দরকার। উপরিতলে বার্তাটি আকর্ষণীয়, আকস্মিকও নয়। দেশের শীর্ষ ক্ষমতাভিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দলের প্রচারে ‘আত্মশক্তি’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ গুরুত্ব পেয়েছে, এনইপি বা জাতীয় শিক্ষানীতি স্বদেশিয়ানাকে আদর্শ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। সমস্যা হল, কেবল উপরিতল থেকে দেখলে এক বিপজ্জনক সরলীকরণ হতে পারে, এ ক্ষেত্রে তা হয়েছেও বটে। মেকলে-র ভাবনাচিন্তার নিন্দা করা এক কথা, আর তার সঙ্গে স্বদেশিয়ানা বা মেক ইন ইন্ডিয়া-র সরলরৈখিক সম্পর্ক তৈরি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রস্তাব। বিষয়টি আর একটু জটিল, যা বোঝার জন্য আর একটু সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসবোধ প্রত্যাশিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন বুঝেছিলেন, পরিস্থিতি আজও তেমনই, বা ততোধিক, ভয়ানক— দেশহিতৈষার কৃশ ও বিকৃত রূপের মধ্যে ইতিহাসবোধের লেশমাত্র নেই।
সেই বোধ থাকলে বোঝা যেত, প্রথমত, অতি-ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি যে ভারতীয় সমাজ-রাজনীতির বড় সমস্যা ও সঙ্কট, তা তর্কাতীত সত্য। কেবল ভারত নয়, সাম্রাজ্যবাদের অবসানে উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্বের সমগ্র পরিসরেই গভীর পাশ্চাত্য-অনুকরণ মিশে গিয়েছিল, যা নিয়ে বিস্তর তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক আলোচনা হয়েছে বিগত কয়েক দশকব্যাপী। ফলে সনাতন হিন্দুত্বের আয়োজন ও আহ্বান ছাড়াই ঔপনিবেশিক মানসিকতা প্রতিরোধ চলেছে, চলবে। দ্বিতীয়ত, যে ইংরেজি-শিক্ষিত সমাজকে নিন্দাবাণে বিদ্ধ করতে ব্যস্ত মোদী, সেই সমাজই কিন্তু একদা প্রবল ভাবে মেকলে-বিরোধিতা করে, ‘মেকলে মিনিটস’-এর বাইরে গিয়ে বিকল্প চিন্তার বিকাশ ঘটায়। ‘অ্যাংলিসিস্ট’দের বিপরীতে যে ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’রা ভারত-আকাশে উদিত হয়েছিলেন, ভারতের শিক্ষিত-সংস্কৃত সমাজ তাঁদেরই উত্তরাধিকারী। প্রসঙ্গত, জওহরলাল নেহরু স্মরণীয়। ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইটির নাম থেকে শুরু করে ছত্রে ছত্রে এই ‘প্রতিরোধ’ জাজ্বল্যমান। তিনি মনে করিয়েছিলেন, হিন্দু ব্রাহ্মণ সমাজ কেমন ভাবে ব্রিটিশদের এবং অব্রাহ্মণদের সংস্কৃত শেখাতে অস্বীকার করেছিল, এবং উইলিয়াম জোনস-এর মতো ইংরেজ পণ্ডিতের নিরন্তর প্রয়াসেই ভারতের মানুষের কাছে সুগম্য হয়েছিল সংস্কৃত ভাষা, শাস্ত্র ও সাহিত্য। জোনস ও আরও বহু ইংরেজ প্রাচ্যবিদের জন্যই প্রাচীন ভারতের ধর্ম সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে উনিশ শতকের ভারতের পরিচয় ঘটে— স্বাদেশিকতার বোধ তৈরিতে যে পর্ব অবিস্মরণীয়। সুতরাং ভারতবাসীর গভীর কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত— ‘টু জোনস, অ্যান্ড টু দ্য মেনি আদার ইউরোপিয়ান স্কলার্স’। মহাত্মা গান্ধীর উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভগবদ্গীতা এবং অন্যান্য সংস্কৃত শাস্ত্র তিনি পড়েছেন ইংরেজিতেই— তাঁর নিজের ভাষা গুজরাতিতেও তা অনুবাদ হয়েছে ইংরেজি থেকেই। ফলে ইংরেজি ভাষা ভারতে কত বড় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, তার সম্যক বোধ থাকলে ইংরেজিকে সমূলে বিসর্জন দেওয়ার ধুয়া তোলা অসম্ভব।
অথচ বর্তমান ভারতে বিকৃত দেশহিতৈষার ধ্বজাধারীরা ভুলেই গিয়েছেন, কিংবা জানতে পারেননি যে অন্যের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজের ভাষার দ্বন্দ্ব মেটানোর প্রয়াস এই বিশ্বদুনিয়ায় অনেক দিন চালু হয়েছে। নিজের ভাষা-সংস্কৃতি-সভ্যতা বজায় রেখে অন্য ভাষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতা থেকে ভাল উপাদান গ্রহণ করা এখন দুনিয়াব্যাপী মান্য ধারা। আধুনিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তি তার বিশেষ সহায়ক। বিদেশি জ্ঞান, তথ্য, যুক্তি, প্রযুক্তি এড়িয়ে বর্তমান জীবন যাপন আজ সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়। সহজ ও সস্তা স্বাদেশিকতার রাজনীতির ধুয়া তুলে অপর সংস্কৃতিকে, এমনকি ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিকে গালমন্দ করার অর্থ এখন, পঙ্কিল সঙ্কীর্ণতার আবাহনে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)